অসৎ টাকা, অবৈধ কাজের গরম কমলে বাতাসের গরমও কমবে

আহাদ উদ্দিন হায়দার

আপডেট : ০৪:৫২ পিএম, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩১

বৈশাখ ও জৈষ্ঠ।
খরা, কাল বৈশাখী আর কাঁঠাল পাকা গরম। আমাদের দেশে এই দুই মাসের গরম কি নতুন কিছু?
যারা ষাটোর্ধ, তারা কি রাস্তার পিচগলা গরম দেখেন নি? মধ্য দুপুরে গ্রামের গাছ তলায় বসেও লু বাতাসের গরম অনুভুতি পাননি? কলকলিয়ে ঘেমে নেয়ে কাজ থেকে ছাতি মাথায় বাড়ি ফেরেননি?
চাষি, মজুর, শ্রমিক, ঠ্যালা আর রিক্সা চালকদের কথা না-ই বলি।
মাত্র বছর কুড়ি আগেও কতো পরিবারের পাকা বাড়ি ছিলো? কতো পরিবারে বিদ্যুত, ফ্রিজ টিভি, এসি ছিলো? কয়টা বাড়িতে ঘরে ঘরে সিলিং ফ্যান ছিলো? কয়টা পরিবারে গাড়ি ছিলো?
আমাদের জীবনে উন্নয়ন এসেছে। পিচঢালা পথ, মেট্রো, রেল, ইজিবাইক, শীতাতপ গণ পরিবহণ কতোকিছু পেয়েছি। ১৭ কোটি মানুষের হাতে ২০ কোটি মোবাইল ফোন এসেছে। পকেটে টাকা এসেছে ভুরি ভুরি। জরুরী প্রয়োজনে লাখ টাকা জোগাড় করা এখন নস্যি তাদের, সেদিনও যাদের ঘর থেকে আকাশ দেখা গেছে। রুচি আরও সুস্বাদু হয়েছে। প্রতি বেলার পাতে আমিষ বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য পাগলা ঘোড়া, তবু বাজারীর ভীড় কমে না। নিরক্ষর, অর্ধ শিক্ষিত কয়েকটি প্রজন্মের সন্তানরা কথিত উচ্চশিক্ষা পেয়েছে। প্রবাসী বেড়েছে। রেমিটেন্স বাড়ছে আবার বেগমপাড়াও প্রসারিত হচ্ছে দেশে দেশে। মেধা পাচার সংস্কৃতিতে বাধ্য হয়েছে মধ্যবিত্ত। এসবের পেছনে মোটা দাগে কাজ করেছে ঘুষ, দুর্ণীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি আর তৈল মর্দন প্রযুক্তি। ভেঙেছে সমাজবন্ধন, ভেঙেছে যৌথ পরিবার। সমাজের প্রাণ মধ্যবিত্ত বিলুপ্তির পথে। শহর আর গ্রামের বিভাজন বেড়েছে। গ্রামীণ জমির বৃহৎ মালিকানা এখন শহুরে উচ্চবিত্তের হাতে। নীতি, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ, ধর্মের অনুশাসন এমন কি দেশপ্রেম দুর্বল হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির দুষ্টচক্র কার্যকর হয়েছে। এখন কার্যত সমাজে দুটি স্তর- বিত্তশালী আর বিত্তহীন। স্বীকার করি বা না করি, আমরা সবাই এসব জানি এবং বুঝি।
এবার আসুন ভাবি, আমি আপনি আমরা অন্যায়ভাবে ব্যক্তিস্বার্থে কত ভূমির শ্রেণী বিলান থেকে বাস্তুতে নিয়ে গেছি? কতো নদী-খাল, কতো বিল দখলে নিয়ে, কত পুকুর জলাশয় ভরাট করে, এদেশের পরিবেশ প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী বাস্তুতন্ত্রের কি পরিমাণ ক্ষতি করেছি? কতো বন উজাড় করেছি? সড়কপাশের কতো গাছ কর্তন করেছি? টাকার বিনিময়ে পরিবেশবিরোধী কতো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে দেশকে আজ এই প্রান্তে এনে দাড় করিয়েছি?
গাছ কাটবো, এসি আর বিলাসী গাড়ি চালাবো, ভারি কারখানা বানাবো, সাশ্রয়ী হতে কার্বনকে বিকল্প জ্বালানী বানাবো, নদী গিলে খেয়ে গলায় 'গরম' বাধলে চিৎকার করবো!
তা হবে কেন?
এদেশের খেটে খাওয়া গরীব এখনও গরম সহ্য করে। তারা কাজ করে, রিক্সা চালায়। তাদের বদ্ধ ঘুপচি ঘরে বিলাস কম। তাদের ঘরের পুরুষদের 'সুলতানের পেশী' নেই। নারীদের শরীরে জৌলুস নেই। সন্তানদের স্বপ্নহীন জীবন, মলিন পোষাক। তারা ফেসবুক কাপায় না।
আমরা যারা অপরাধ করেছি, অবৈধ কাজ করেছি, আমরা যারা মানুষের অধিকার লুন্ঠন করেছি, সোস্যাল মিডিয়ায় তো তাদেরই আধিপত্য। লাখ লাখ বেকার তরুণের হাতে বাইক তুলে দিয়েছেন পিতা মাতা কোন হালাল উপার্জনের টাকায়? আমরা তো টাকা করেছি দশ প্রজন্মের ভোগ নিশ্চিত করতে। তাহলে আমরা গরমে হাপিয়ে চিৎকার করি কেন? আসুন আমরা গরম ঠেকাতে শীত কিনে আনি।
কই, কৃষকের ধানের কথা তো বলি না। শ্রমিকের ঘামের কথা তো বলি না। তৃষ্ণার্ত দিন মজুরের জন্য পানি বা স্যালাইন নিয়ে তো দাড়াই না। দিনমজুরের জন্য ১০০ টাকা পারিশ্রমিক তো বাড়াই না, কিম্বা তাকে দিয়ে এক ঘন্টা কাজ তো কম করাই না।
সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর পরীক্ষাও বন্ধ করার দাবি তোলেন আমাদের বন্ধুরা। অন লাইন ক্লাসেও অনিহা। সেশন জটের ধাক্কায় চাকুরীর বয়স হারালে সেদিন কি মনে থাকবে, আমরাই দাবি তুলে এই জট বাড়িয়েছিলাম?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। আমাদের সন্তানেরা কি ঘরে বসে আছে? রাস্তায়, আড্ডায়, কাজে অকাজে কি তারা ঘন্টার পর ঘন্টা বাহিরে কাটাচ্ছে না? তাহলে এই হা হুতাশ, হুজুগ কেন?
আর কয়েক দিনের মধ্যে ফসল তুলবে কৃষক। কটা দিন আগে ঝড় বৃষ্টি হলে সে কোথায় যাবে? কোথায় যাবে তার ফসল? স্রস্টার কাছে কৃষক দুদন্ড সময় চাইছে ফসল তোলার। আর শহুরে পরজীবীরা চাইছেন এখনই ঝড়-বৃষ্টি, কালবৈশাখী। ধানের দাম বাড়লে সরকারকে গালি দিয়ে ১৭০ টাকা কেজিতে আমরা ঠিকই বাশমতি কিনে খাবো। মরবে চাষি, মরবে গরীব, বিত্তহীনের দল। আমরাই তখন সরকারকে গালি দিয়ে সর্বহারাদের উষ্কে দিব। কষ্টার্জিত বৈদেশিক মূদ্রায় খাদ্য কিনতে সরকারকে বাধ্য করবো।
হায়রে শ্রেণীস্বার্থ!!
আমরা শুধু নিজেদের নিয়েই ভাবি।আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য দেশের কথা ভাবি না। নিজেকে বাঁচাতে নতুন প্রজন্মকেই এখন পিতা মাতার উপার্জনের খোঁজ নিতে হবে। পরিবারের আয়ের সাথে ব্যয়ের বিশাল অসামঞ্জস্যতার সূত্র খুঁজতে হবে। পরিবার থেকে ঘুষ, দুর্ণীতি আর মানুষের সম্পদ গ্রাসের চর্চা বন্ধ করে দিতে হবে।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
আহাদ উদ্দিন হায়দার
সাংবাদিক।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত