ভয়াল সুপার সাইকোন সিডরের দশম বর্ষপুর্তি

১০ বছরেও আতঙ্ক কাটেনি উপকূলবাসির

মহিদুল ইসলাম

আপডেট : ০৬:০৬ পিএম, মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর ২০১৭ | ৯৩৭

ভেড়িবাধ

১৫ নভেম্বর ভয়াল সুপার সাইকোন সিডর দিবস। ২০০৭ সালের ১৫নভেম্বর সংঘটিত সেই সুপার সাইকোন সিডরের দশম বর্ষপুর্তি। সরকারী হিসেব মতে এক সাউথখালী ইউনিয়নেই মারা যায় সাড়ে ৯ শত ৮জন মানুষ। তবে বেসরকারী হিসেবে এই ইউনিয়নে মারা যায় হাজারো মানুষ। সিডরে সব থেকে বেশি তিগ্রস্থ হয়েছিল বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোড়েলগঞ্জ উপজেলার মানুষ। শুধুমাত্র শরণখোলা উপজেলার সাউথ খালীতে প্রান হারায় ৯‘শ ৮ জন মানুষ। দুমড়ে-মুচড়ে যায় গোটা উপকুল। সাউথ খালী এলাকার হাজারো মানুষের ঘর-বাড়ী বিলিন হয়ে যায় বলেশ্বর নদীতে। সিডরের পরে দুই উপজেলার মানুষের দাবি ছিল একটি টেকসই ভেড়িবাধ। দশ বছর কেটে গেলেও নির্মান হয়নি কাঙ্খিত ভেড়িবাধ।ওই প্রকৃতিক দূর্যোগ কাটিয়ে ধীরে-ধীরে ঘুরে দাড়ালেও তারা এখন চায় টেকসই বেড়িবাধ। সেকারনে সিডরের ধ্বংসস্তুপ থেকে জেগে ওঠা উপকূলীয় বাগেরহাটের শরণখোলার হাজরো বিধ্বস্ত কন্ঠে দাবি উচ্চারিত হয় ‘আমরা ত্রাণ চাইনা- একটি টেকসই বেড়িবাধ চাই’। টেকসই বেড়িবাধ না থাকায় প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড় সিডর বাগেরহাটের এই উপজেলার সহ¯্রাধিক প্রাণ কেঁড়ে নেয়। সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে হাজার হাজার পরিবার।

ফাইল ছবি

বিধ্বস্ত এ জনপদের মানুষ স্বজন হারানোর শোক ভুলে সে দিনের পর থেকে একটি টেকসই বাধের দাবিতে গড়ে তোলে আন্দোলন। সেই আন্দোলন চলতে থাকে বছরের পর বছর। এরই প্ররিপ্রেক্ষিতে অবশেষে বাধ নির্মান কাজ শুরু হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে শরণখোলাবাসীকে। নামে টেকসই বেড়িবাধ বলা হলেও বাস্তব অবস্থাটা একেবারেই ভিন্ন। মাটির কাজ চললেও নদী শাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ব্লক ডাম্পিং করে নদী শাসন না করেই নির্মান কাজ শুরু করায় চলতি মাসে গাবতলা এলাকায় ৩ দফা বাধ ধসে পড়ছে। এতে বাধ কতোটা টেকসই হবে! ঘুরে ফিরে সেই প্রশ্ন উঠে আসছে উপকূলের আতংকিত মানুষের মুখে।

২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে ‘সিএইচডব্লিউই’ নামের চায়নার একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মাটি ও ব্লক বাধ নির্মান কাজ বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে শরণখোলা উপজেলার চারটি ও মোরেলগঞ্জ উপজেলার একটিসহ মোট পাঁচটি ইউনিয়ন “সিইআরপি” নামে এ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। প্রায় দুই বছরে বলেশ্বর ও ভোলানদী বেষ্টিত শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ উপজেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৩৫/১ ও ৩৫/৩ পোল্ডারের ৬৫ কিলোমিটার বাধের প্রায় ৩০ ভাগ কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এমনটা দাবি করছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বলেশ্বর নদ তীরবর্তী খোন্তাকাটা, রায়েন্দা ও সাউথখালী এলাকা সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ। উপজেলার চারটি ইউনিয়নের মধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এই তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ২০ কিলোমিটার বাধের মাটির কাজ শুরু হয় প্রথমে। কাজ চলমান থাকার মধ্যেই সাউথখালী ইউনিয়নের বগী কমিউনিটি কিনিকের সামনে ও নতুন স্লুইচগেটের উত্তর পাশের দুটি পয়েন্ট, তাফালবাড়ি লঞ্চঘাট সংলগ্ন স্লুইচগেট, গাবতলা বেড়ি বাধের দুটি পয়েন্ট, রায়েন্দা ইউনিয়নের রাজেশ্বর, লাকুড়তলা এবং খোন্তাকাটা ইউনিয়নের পূর্ব খোন্তাকাটা (কুমারখালী) এলাকাসহ প্রায় ১০টি পযেন্ট বলেশ্বর নদের ঢেউয়ের আঘাতে একাধিকবার ধসে পড়ে। নদী শাসন না করার কারণে প্রবল ঢেউয়ে বাধের তলদেশ থেকে মাটি সরে গিয়ে বার বার এমন বাধে ধ্বসের সৃষ্টি হচ্ছে।

দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর কাঙ্খিত বাধ নির্মান শুরু হওয়ায় বিধ্বস্ত এই জনপদের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিলো। ভেবেছিলো জলোচ্ছ্বাসে তাদের আর জানমাল কিছুই হারাতে হবেনা। কিন্তু বাধের কাজের মান এমন পর্যায় যা, তাদেরকে এখন আরো আতঙ্কিত করে তুলেছে।

সাউথখালী ইউনিয়নের বেড়িবাধ সংলগ্ন তাফালবাড়ি এলাকার বাসিন্দা ফরিদ খান মিন্টু, উত্তর সাউথখালী ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম হালিম, বগী ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রিয়াদুল পঞ্চায়েত, চালিতাবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা আ. রাজ্জাকসহ অনেকই আক্ষেপ করে বলেন, সিডরের পর সরকারের কাছে শরণখোলার মানুষের প্রাণের দাবি ছিলো একটি টেকসই বেড়িবাধের। দীর্ঘ বছর পর তা শুরু হলেও মানুষের মনে আশা জাগাতে পারেনি। টেকসই বাধের নামে আমাদের সাথে প্রহসন করা হয়েছে। গাবতলা এলাকায় চলতি মাসে ৩ দফা ভেড়িবাধ নদীগর্ভে ভেঙ্গে গেছে। একদিকে নদী ভাঙছে, অন্যদিকে মাটির পাহাড় গড়া হচ্ছে। নদী শাসন না করে বাধ মাটি দিয়ে যতোই উঁচু করা হোক, তা কোন কাজে আসবেনা।

শরণখোলা উপজেলা নদী শাসন বাস্তবায়ন আন্দোলন কমিটির আহবায়ক ও রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিলন বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, সিডর পরবর্তী এ এলাকার মানুষের স্বপ্ন ছিলো একটি টেকসই বেড়িবাধের। কিন্তু বাধের নির্মান কাজ শুরু হলেও ভিত একেবারেই দুর্বল। নদী শাসন না করেই বাধ নির্মান করায় ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার বাধের বিভিন্ন পয়েন্ট ধসে পড়েছে। নদী শাসন না করে বাধ নির্মান হলে সরকারের এ প্রকল্পে বরাদ্দকৃত প্রায় ৬০০ কোটি টাকা জলে ভেসে যাবে। তিনি আরো বলেন, নদী শাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর একাধিক স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। প্রকল্পের টেন্ডার মানি দিয়েই নদী শাসনের কাজ করা সম্ভব বলে তিনি উল্লেখ করেন।

চায়নার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘সিএইচডব্লিউই’র কাজ তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েল হ্যাসকনিং গ্রুপের সুপারভেশন ইঞ্জিনিয়ার শ্যামল কুমার দত্ত বলেন, আমাদের কাজ চলমান রয়েছে। ২০১৮ সালের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে আশা করি। এক কিলোমিটার এলাকার নদী শাসন না করলে বাধ টিকবেনা । সেকারনে বিশ্ব ব্যাংকের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।

সিআইপি প্রকল্পের নির্বাহী প্রোকৌশলী মো. আব্দুল হান্নান বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, নির্মানাধীন ভেড়ীবাধ নির্মানের সম্ভ্যাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছিল ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে। সে সময়ে প্রকল্প এলাকায় নদী শাসনের প্রয়োজনীয়তা ছিলনা। বর্তমানে সিইআইপি-০১ প্রকল্পের আওতায় বাগেরহাট-খুলনা- সাতরিা মিলে ৯.২৫ কিলোমিটার নদী শাসনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এজন্য অতিরিক্ত ৬‘শ৮০ কোটি টাকা প্রয়োজন। যা দাতা সংস্থা বিশ্ব ব্যাংককে জানানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোন উত্তর মেলেনি।

বাগেরহাটের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. মামুন উল হাসান বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, শরণখোলায় ভেড়ীবাধ নির্মানের কাজ চলছে। কিছু কিছু জায়গায় বাধ ধ্বসে যাচ্ছে। বাধ টেকসই করতে গেলে নদী শাসন ছাড়া টিকিয়ে রাখা কষ্টকর।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত