আউটসোসিং ও ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষনের দাবী

দক্ষ প্রশিক্ষক ও জনবল সংকটে বাগেরহাট যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর

মামুন আহমেদ

আপডেট : ১২:০২ এএম, বুধবার, ২২ জুন ২০২২ | ১৩০৯

বেকার যুবকদের যুগপযোগী প্রশিক্ষনের মাধ্যমে উন্নয়নের মূল ধারায় ফিরিয়ে এনে দেশ গঠনে অংশগ্রহন বাড়াতে কাজ করছে বাগেরহাট যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। কিন্তু দক্ষ প্রশিক্ষক ও জনবল সংকটে ভুগতে থাকা এ প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে চড়ম ভাবে। এছাড়া বাগেরহাট জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষন নেয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ চাদিহা অনুযায়ী ভালো প্রশিক্ষন পায়নি তারা।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, দক্ষ কারিগরি শিক্ষার অভাবে কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারছেন না তারা। তাই বেকারত্ব ঘোচাতে আউটসোসিং ও ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষনের দাবী শিক্ষার্থীদের। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বলছে জনবল সংকটে থাকলেও সাধ্য অনুযায়ী কাজ করছেন তারা।


তবে বাগেরহাটের সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছে, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চাহিদা অনুযায়ী উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, দক্ষ প্রশিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহ এ সমস্যার সামাধান।



শিক্ষার্থীদের দাবী ও অভিযোগ
বাগেরহাট যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে গত ২০২০-২১ অর্থ বছর ও ২০২১-২২ অর্থ বছরে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষন নেয়া শিক্ষার্থীরা জানান, যুব উন্নয়ন থেকে নেয়া এ প্রশিক্ষণ কর্মক্ষেত্রে তাদের কোন কাজে আসছে না। যার মূল কারন হচ্ছে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ প্রশিক্ষক দ্বারা যুগপযোগী প্রশিক্ষণ না পাওয়া। অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সার্টিফিকেটের জন্য ও আর্থিক সুবিধার জন্য প্রশিক্ষণ নেয়াকেও দায়ী করছেন শিক্ষর্থীরা।



বাগেরহাট সদর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলিমুজ্জামান বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, গত বছর আমি বাগেরহাট যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে কম্পিউটার এর প্রশিক্ষণ নিয়ে ছিলাম। এ প্রশিক্ষনের মাধ্যমে আমি যা শিখেছি, সেটা শুধু মাত্র কম্পিউটার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনা। প্রতিযোগীতার এ যুগে এসে প্রাথমিক ধারনা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ কম। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাব রয়েছে। শুধু মাত্র একজন দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাবে যুব উন্নয়ন থেকে কাংখিত প্রশিক্ষণ পাচ্ছি না আমরা।

বাগেরহাট সদর উপজেলার ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের বাসিন্দা ন্সিগ্ধা ফাতেমা বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, আমি এ বছরের জানুয়ারীতে যুব উন্নয়ন থেকে মৎস্য চাষের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। যা আমার কোন কাজেই আসেনি। তাদের যে প্রশিক্ষক ছিলো তিনি যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন না। তিনি মুখে বলেই নাম মাত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। প্রাকট্রিক্যাল ভাবে শেখার কোন সুযোগ ছিলো না সেখানে। এ ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার প্রমান দেয়া সম্ভব না। এছাড়া অনেক শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিয়েছে শুধুমাত্র সার্টিফিকেট ও আর্থিক সুবিধার জন্য। চাহিদা অনুযায়ী ভালো মানের দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাব রয়েছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের।

একই ইউনিয়নের বাসিন্দা ইমরান শেখ বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, আমি যুব উন্নয়ন থেকে কম্পিউটার এর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আমার কাছে এ প্রশিক্ষণ কম্পিউটার সম্পর্কে বেসিক ধারনা ছাড়া কিছুই মনে হয় না। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমি যা পেয়েছি সেটা শুধু মাত্র একটি সার্টিফিকেট। এর বাইরে যা শিখেছি, সেটা আধুনিক এ যুগে “ইউটিউব” দেখে শেখা যায়। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে নতুন করে ভাবতে হবে। দক্ষ প্রশিক্ষকের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের চাহিদার মূল্যায়ন করতে হবে। দক্ষ প্রশিক্ষক দ্বারা আউটসোসিং ও ফ্রিল্যান্সিং এর উপর উন্নতমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই আমাদের মত তরুন যুবকরা বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে।


সদর উপজেলার কাড়াপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা তানজিম আহমেদ বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, করোনা মহামারির কারনে অনলাইনে কাজ করার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারনে বর্তমান সময়ে আমাদের মত যুবকদের কাছে পছন্দের পেশা হয়ে উঠছে আউটসোসিং ও ফ্রিল্যান্সিং। ভালো প্রশিক্ষনের মাধ্যমে এ সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে আমাদের। এসব করতে হলে যুব উন্নয়নে দক্ষ প্রশিক্ষকের দ্বারা চাহিদা অনুযায়ী আউটসোসিং, ফ্রিল্যান্সিং ও মোবাইল সাভিসিং এর মত বিষয় গুলোর উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই প্রতিটি পরিবারে একজন করে উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে।


একই ইউনিয়নের বাসিন্দা মাইনুল ইসলাম হিমু বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, আমি ঢাকা শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট থেকে ট্যুরিজমের উপর প্রশিক্ষন নিয়ে ছিলাম। যেটি আমার কাছে অনেক আধুনিক ও যুগযোগী মনে হয়েছে। বর্তমান আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বাগেরহাট যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষনের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। ঢাকার মত উন্নত মানের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া বর্তমান সময়ে আমাদের মত তরুন যুবদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা আউটসোসিং ও ফ্রিল্যান্সিং এর উপর ভালো মানের প্রশিক্ষণের দাবী জানাচ্ছি।


সংকট সমাধানে যা বলছেন সচেতন নাগরিক সমাজ
বাগেরহাট যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের দক্ষ প্রশিক্ষক ও জনবল সংকট সমাধানের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার দাবী জানিয়েছেন বাগেরহাটের সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, সরকারি ভাবে কিছু উদ্যোগ ও সকলের আন্তরিকতায় সংকট কাটিয়ে উঠে যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষণকে আধুনিকায়ন করা সম্ভব।

বাগেরহাট প্রেসক্লাবের সভাপতি নীহার রঞ্জন সাহা বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, দেশের বেকার যুবদের দক্ষ মানব সম্পদে রুপান্তর করতে কাজ করছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। আধুনিক এ যুগে এসে যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষণ নিয়ে তরুন যুবদের মধ্যে চাহিদা, দাবী ও অভিযোগ থাকতেই পারে। এখানে যে বিষয় গুলো বলা হচ্ছে সেগুলোকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে হবে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরকে। তরুন যুবদের চাহিদার মূল্যায়ন করে সমস্যা গুলোকে চিহ্নিত করে সে গুলো সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, দেশের বেকার যুবকদের তালিকায় শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত সবাই আছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক সত্যি হচ্ছে, কোনো যুবককে বেকার অবস্থায় দেখলে আমাদের মনে হয়, হয়তো ঘুষ দেওয়ার সামর্থ্য নেই কিংবা মামা-খালু নেই বলেই বেকার। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে এই বেকার যুবকদের আমরা কতটা দক্ষ করে তুলতে পেরেছি। দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা আজ দক্ষতার লড়াইয়ে পিছিয়ে থাকার কারণে সঠিক কর্মের সন্ধান পাচ্ছে না। ফলে বেকারত্বের লাইন আরও দীর্ঘ হচ্ছে। এসব থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে আমাদের। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ সমস্যার সমাধার করতে হবে। যেমন, বেকার যুবকদের জন্য যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চাহিদা অনুযায়ী উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, যুব উন্নয়নে দক্ষ প্রশিক্ষক এর ব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহ থাকলেই এ সমস্যার সামাধান করা সম্ভব হবে।

বাগেরহাট ফাউন্ডেশনের সাধারন সম্পাদক আহাদ উদ্দিন হায়দার বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, প্রাণঘাতি করোনা মহামারি আমাদের অনলাইনে কাজের সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের তরুন যুবরা কাছে এখন ঘরে বসে আউটসোসিং ও ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বি হচ্ছে। তরুন যুবদের কাছে এখন পছন্দের পেশা হয়ে উঠছে আউটসোসিং ও ফ্রিল্যান্সিং। তাই এ বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষনের চাহিদা বাড়চ্ছে। ফ্রিল্যান্সিং এর বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠতে হাজার হাজার টাকা ব্যায় করছে শিক্ষার্থীরা। ইচ্ছা থাকলেও জেলার দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা ভালো মানের প্রশিক্ষণ পাচ্ছে না। যে কারনে তারা পিছিয়ে পড়ছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরকে এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে হবে। পিছিয়ে পড়া তরুন যুবদের জন্য আউটসোসিং ও ফ্রিল্যান্সিং এর উপর উন্নত প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের যে প্রশিক্ষকরা রয়েছেন, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এটা করা গেলেই যুব উন্নয়নের এ প্রশিক্ষণ থেকে শতভাগ সুফল পাবে শিক্ষার্থীরা।


যা বলছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর
চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ প্রশিক্ষক ও জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে বাগেরহাট যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ মাসুদুল হাসান মালিক বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাব ও জনবল সংকটে থাকলেও সাধ্য অনুযায়ী আন্তরিকতার সাথে কাজ করছেন তারা।


তিনি বলেন, বর্তমানে বাগেরহাট যুব উন্নয়ন অফিসসহ আমাদের উপজেলা অফিস গুলোতেও জনবল সংকট রয়েছে। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি জনবল সংকটে রয়েছে জেলার রামপাল উপজেলা। সেখানে ক্রেডিট সুপার ভাইজার, অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক ক্যাশিয়ার, অফিস সহায়ক ও উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাসহ কর্মরত পদের ৭ জনের বিপোরীতে ৫টি পদই শূণ্য রয়েছে। এছাড়া শরণখোলা উপজেলা কর্মরত পদের ৭ জনের বিপরীতে ৩টি, মোড়েলগঞ্জে ৪টি, মোল্লাহাটে ২টি, মোংলায় ২টি, সদরে ২টি ও ফকিরহাট, চিতলমারী ও কচুয়া উপজেলা ১টি করে পদ শূণ্য রয়েছে। এর মধ্যে জেলা কার্যালয়েও একজন সহকারী পরিচালক ও একজন উচ্চমান সহকারীর পদ শূন্য রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যে অভিযোগ বা দাবী করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সে গুলো অযৌক্তিক বা ভুল বলা যাবে না। এ গুলো এখন সময়ের দাবী। তবে আমাদের যারা প্রশিক্ষক রয়েছে তারা যে দক্ষ নয় সেটাও বলা যায় না। কারন দীর্ঘদিন ধরে তারা যুব উন্নয়নে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসচ্ছে। এখাতে সমস্যা হচ্ছে বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এখানে যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষদের দক্ষতার অভাব থাকলে তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলা হবে। এছাড়া আউটসোসিং ও ফ্রিল্যান্সিং এর উপর যে প্রশিক্ষণের দাবী করছে তরুন যুবরা, আমি নিজেও তাদের সাথে সহমত পোশন করছি। এটি এখন সময়ের দাবী। এ অর্থ বছর যেহেতু প্রায় শেষ, সে ক্ষেত্রে আগামী অর্থ বছরে যুবদের চাহিদার ভিত্তিতে আউটসোসিং ও ফ্রিল্যান্সি এর উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে বলে জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত