চিতলমারীতে শ্রমিকের অভাবে ধান নিয়ে ভোগান্তিতে চাষিরা

এস.এস.সাগর

আপডেট : ০৬:১৯ পিএম, মঙ্গলবার, ৫ মে ২০২০ | ১৩২৬

‘মোটা অংকের টাকায় জমি লিজ নিয়েছি। বড় আশা নিয়ে তিন একর জমিতে ধান চাষ করেছি। বোরো ধানের ফলনও হয়েছে বাম্পার। জমিতে ধান গুলো পেকে ঝনঝনা হয়ে গেছে। কিন্তু ধান কাটার শ্রমিকই পাচ্ছি না। কষ্টার্জিত এ ফসল ঠিকমত ঘরে তুলতে পারব কিনা তা নিয়ে মনে নানা সংশয় দেখা দিয়েছে। গত বছর খুলনার কয়রার পরবাসি দাদারা (ধান কাটা শ্রমিক) এসে ধানা কেটে মাড়াই ও ঝেড়ে শুকনা করে দিয়ে গিয়েছিল। এবার করোনার কারণে তারা কিছুতেই আসতে রাজি নন। তাই মাঠের পাকা বোরো ধান নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছি।’ মঙ্গলবার দুপুরে নিজের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে এমনটাই বললেন বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার কুরমনি গ্রামের বর্গা চাষি অচ্যুত বসু (৫৬)।

কৃষক বাবুল গাজি (৪৮)। নিজের প্রায় দু’বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন। ক্ষেতের ধান গুলো পেকেছে। পাচ্ছেন না ধান কাটার পরবাসি বা শ্রমিক। তাই তিনিও মাঠ ভরা পাকা বোরো ধান নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় পড়েছেন। বাধ্য হয়ে শ্রমিকের জন্য তিনি ছুটবেন ফকিরহাটে। এমনটাই জানিয়েছেন সাংবাদিকদের।

আরেক বর্গা চাষি পরিমল বিশ্বাস (৪৬)। তিনিও নগদ জমায় আড়াই একর জমি নিয়ে বোরো ধানের চাষ করেছেন। এবার ধানের ফলনও হয়েছে বাম্পার। কিন্তু কাঙ্খিত ধান কাটার পরবাসি না পেয়ে বহু কষ্টে উৎপাদিত ধান নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছেন।

শুধু অচ্যুৎ বসু, বাবুল গাজি আর পরিমল নয়, মরণঘাতি করোনার কারণে এবার মাঠের পাকা ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছে এ উপজেলার কয়েক হাজার কৃষক। স্থানীয় ধান চাষিরা এমনটা দাবি করলেও সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর গুলো জানিয়েছে ভিন্ন কথা। তারা জানান, অন্য এলাকা থেকে ধান কাটা শ্রমিকদের আনার ব্যাপারে কোন বিধি নিষেধ নেই। তাদের স্বাস্থ্য পরিক্ষা ও সেখানকার প্রশাসনের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে এসব শ্রমিক আনা সম্ভব। ধান কাটার ব্যাপারে চাষিদের সার্বিক সহযোগিতার জন্য সরকারের নির্দেশনাও রয়েছে।


উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ২১ টি ব্লক রয়েছে। এখানে এ বছর প্রায় ৩০ হাজার একর জমিতে বেরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। এখানে কমপক্ষে ২৫-৩০ হাজার কৃষক পরিবার এই বোরো ধানের চাষের সাথে জড়িত।


ধান চাষিরা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরে ধান চাষ করে তাদের লোকসান গুনতে হয়েছে। তবুও সব লোকসান মেনে তারা জমি অনাবাদি ফেলে রাখতে নারাজ। কৃষি প্রধান এ এলাকার শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই চাষাবাদের সাথে যুক্ত। দেশের অন্যতম সবজি ও চিংড়ি চাষ হয় এখানকার জমিতে। পাশাপাশি বোরো আবাদেও বড় ভূমিকা রেখে আসছে এখানকার চাষিরা। গত কয়েক বছর ধরে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে চিংড়ি ও সবজি চাষ হুমকির মুখে। অনেকেই বিভিন্ন ব্যাংক, এনজিও এবং সুদেকারবারীদের কাছ থেকে অধিক মুনাফায় টাকা এনে কৃষি কাজে ব্যয় করেছেন। বিগত দিনে কৃষি কাজের জন্য ঋণ এনে অনেকেই পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছেন। এ অবস্থায় শেষ ভরসা এখন বোরো ধানকে ঘিরে। কিন্তু সে ধান এখন কিভাবে ঘরে তুলবেন সে ভাবনায় দিশেহারা চাষিরা।

উপজেলার কুরমনি গ্রামের ধান চাষি নির্মল বাইন, রেজাউল দাড়িয়া, অনুপ বিশ্বাস, বলরাম বিশ্বাস, শচীন বিশ্বাস, আবু মিয়াসহ এলাকার অনেক চাষি হতাশা প্রকাশ করে বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, মাঠে তাদের আবাদকৃত পাকা বোরো ধান পেকে ঝনঝনা হয়ে গেছে। কিন্তু ধান কাটা শ্রমিকের সংকটে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
তারা ক্ষোভের সাথে আরও জানান, স্থানীয় ভাবে ফটো সেশনের জন্য কিছু লোক সেচ্ছাশ্রমে ধান কাটার কথা বললেও বাস্তবে তারা ধান কেটে কৃষকের উপকার করে না। তারা স্থানীয় কিছু সাংবাদিককে ডেকে এনে ছবি তোলা শেষ হলে ক্ষেতে ধান ফেলে রেখে চলে যায়। এতে চাষিদের উপকারের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশী।

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঋতুরাজ সরকার বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, এ বছর ১১ হাজার ৪ শ’ ৭০ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ও উফসী জাতের ধানের আবাদ করা হয়েছে। এসব জমিতে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ধান কাটার জন্য চাষিদের সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে। কিন্তু এবার অনেক চাষিই করোনার ভয়ে বাইরের ধানকাটা শ্রমিক আনতে রাজি না। অনেক শ্রমিক আবার আসতে রাজি না। যার কারণে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মারুফুল আলম বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, অন্য এলাকা থেকে ধান কাটা শ্রমিকদের আনার ব্যাপারে কোন বিধি নিষেধ নেই। তাদের স্বাস্থ্য পরিক্ষা ও সেখানকার প্রশাসনের প্রত্যায়ন পত্র নিয়ে ধানকাটা শ্রমিকরা আসতে পারেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত