স্বপ্নে পাওয়া আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় চলছে ক্যান্সারসহ সকল রোগের চিৎকিসা
আপডেট : ০৭:১২ পিএম, সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ৩২৭
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নের বলভদ্রপুর গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দা লোকেন মন্ডল। তার বাড়ীতে সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার চলছে স্বপ্নে পাওয়া আধ্যাত্মিক ক্ষমতার চিৎকিসা। একই গ্রামের দিনমজুর আব্দুল মুকিত ওরফে মুকুল আট মাস আগে স্বপ্নে পেয়েছেন এই চিৎকিসা ক্ষমতা। আর এই ক্ষমতা বলেই রাতারাতি বনে গেছেন আধ্যাত্মিক কবিরাজ। বাগেরহাট জেলাসহ আশপাশের জেলা থেকেও শত শত মানুষ রোগ মুক্তির আশায় ভীড় করছেন কথিত কবিরাজ মুকুলের কাছে। শনিবার ও মঙ্গলবার সারাদিন ও রাত ধরে চলছে মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ প্রায় সকল রোগের চিৎকিসা। কবিরাজের দাবি, স্বপ্নে পাওয়া কিছু নির্দেশনা অনুযায়ী চিকিৎসা চালাচ্ছেন তিনি। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, অপচিকিৎসার বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেবেন তারা। আর খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
শনিবার রাতে সরোজমিনে উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নের বলভদ্রপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় শত শত মানুষ চিৎকিসার জন্য এসেছেন লোকেন মন্ডলের বাড়ীতে। ওই বাড়ীর একটি ঘরে বসে স্বপ্নে পাওয়া আধ্যাত্মিক শক্তির নির্দেশনায় নিমপাতার ঝাড়ফুঁক দিয়ে চিকিৎসা করছেন আব্দুল মুকিত ওরফে মুকুল। পেশায় দিনমজুর হলেও গত আট মাস ধরে বনে গেছেন কবিরাজ। মরণব্যাধি ক্যান্সার, প্যারালাইসিস, পাইল্স, স্টোক, মাজা ব্যাথা, বাত-ব্যাথা, জন্ডিস, হাপানি থেকে শুরু করে সকল রোগের চিৎকিসা দিচ্ছেন তিনি।
কবিরাজ মুকুল বলেন, স্বপ্নের মাধ্যমে তিনি আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করেছেন। ওই শক্তির ক্ষমতা বলে তিনি ঝাড়ফুক, তেলপড়া ও পানি পড়া দিচ্ছেন। যাতে সুস্থ্য হচ্ছেন রোগীরা। তার দাবী এই চিৎকিসার বিনিময়ে কারও কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নিচ্ছেন না তিনি। তবে খুশি হয়ে যদি কেউ কিছু দেয়, সেটা তিনি নিচ্ছেন। নিজের বাড়ীতে রোগীদের যেতে কষ্ট হওয়ায়, তাদের সুবিধার কথা চিন্তা করে প্রতিবেশি লোকেন মন্ডলের বাড়ীতে সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার তিনি রোগীদের সেবা দিয়ে থাকেন।
তবে কথিত কবিরাজের দাবী অনুযায়ী তার চিৎকিসায় সুস্থ্য হয়েছেন এমন কোন রোগীকে পাওয়া যায়নি ঘটনাস্থলে। এসময় কথা হয় চিৎকিসা নিতে আসা একাধিক রোগীর সাথে। তারা সবাই জানান, বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে জানতে পেরেছি কবিরাজ মুকুলের কথা। তার কাছে আসলে নাকি সকল রোগের চিৎকিসা পাওয়া যায়। এটা যেনেই রোগ মুক্তি আশায় এখানে এসেছি। আপনাদের মধ্যে কেউ সুস্থ্য হয়েছেন কি না জানতে চাইলে কিশোর মন্ডল নামের একজন এগিয়ে আসেন।
তিনি বলেন, আমার স্ত্রীর মাজায় ব্যাথা ছিলো, বাগেরহাট-খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানে চিৎকিসা করিয়েছি কোন লাভ হয়নি। শেষে মুকুলের কাছে নিয়ে আসলে উপকৃত হয়েছি। আমার স্ত্রী এখন সুস্থ্য। আপনার স্ত্রী এখন কোথায়, এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, সে বাড়ীতে আছে। তাহলে আপনি কেন এসেছেন এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, ভালো লাগে তাই আসচ্ছি।
জাহাঙ্গীর হোসেন নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, মুকুল কাকাকে কখনও কবিরাজি করতে দেখিনি। সে মানুষের বাড়ীতে বাড়ীতে কাজ করে সংসার চালাতো। হঠাৎ করে তিনি রাতারাতি কবিরাজ বনে গেছেন। তার কাছ থেকে চিৎকিসা সুস্থ্য হয়েছেন এমন কাউকে কখনও গ্রামে দেখিনি আমি। এখানে মানুষের সাথে প্রতারনা করা হচ্ছে। যে বাড়ীতে বসে তিনি রোগী দেখেন সেখানে একটি দোকানও করা হয়েছে, চিৎকিসার যত মালামাল ওই দোকানেই পাওয়া যায়। এক টাকার মাল পাঁচ টাকায় বিক্রি করেন ওই দোকানদার। এছাড়া এই প্রতারনা ব্যবসা প্রচার ও প্রসারের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির লোকজন রোগী সুস্থ্য হওয়ার মিথ্যা তথ্য ছড়ায়, যাতে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া কবিরাজ নিজ হাতে টাকা না নিলেও বাইরে থাকা থালায় প্রতিদিন প্রায় হাজার টাকা জমা হয়। ওই টাকার ভাগাভাগি নিয়ে কিছুদিন আগে কমিটির লোকজনের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে।
বনগ্রাম ইউনিয়নের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিমল মন্ডল বলেন, মুকুল যে চিকিৎসা দিচ্ছেন তা স্পষ্ট অপচিকিৎসা। ওখানে তাদের কিছু নিজস্ব লোকজন রয়েছে ওরাই মূলক রোগী সুস্থ্য হওয়ার মিথ্যা গুজব ছড়ায়। তাদের লোকজনই ওখানে থেকে বাইরে থেকে আসা অন্যান্যদের কাছে আমি সুস্থ্য হয়েছি বা সে সুস্থ্য হয়েছে এমন কথা বলতে থাকে। এরা সবাই ওই কমিটির লোক। এটি পরিকল্পিত ভাবে সাজানো। ঠিক লালসালুর মত ঘটনা। আর একটা বিষয় দেখবেন যারা চিৎকিসা নিতে এসেছে তারা অধিকাংশই নারী। এই নারীদের র্টাগেট করে মূলত ব্যবসা চলছে। কারন নারীরা সহজে বিশ্বাস করে। আর কেউ যদি বিশ্বাস না করে, তাকে বিশ্বাস করানোর মত লোকের অভাব নাই ওখানে। অতিদ্রুত এই অপচিকিৎসা বন্ধ না হলে সাধারন মানুষ আরও ক্ষতিগ্র্রস্থ হবে বলে দাবি করেন তিনি।
বনগ্রাম ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য প্রদিপ মজুমদার বলেন, মুকুল কবিরাজ হওয়ার পর সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার রাতদিন ২৪ ঘন্টা রোগীদের সেবা দিয়ে থাকেন। রোগী দেখায় কোন প্রকার ঝামেলা যাতে না হয় সে জন্য আমিসহ ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছি।
লোকেন মন্ডল বলেন, মুকুল গরীব মানুষ। যখন যে কাজ পেতে সেটা করতো। স্বপ্নে গাজি কালুকে পেয়ে হঠাৎ করে কবিরাজ হয়েছেন। তার বাড়ীতে যেতে হলে হাটু সমান কাদামাটি পার হয়ে যেতে হয়। এ জন্য আমার বাড়ীতে বসে রোগী দেখেন।
বাগেরহাট সিভিল সার্জন ডাঃ জালাল আহমেদ বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞান কখনোই ঝাড়ফুকে বিশ্বাস করে না। ওই কবিরাজ যেটা করছে সেটা অপচিকিৎসা। সে সহজ সরল রোগীদের বোকা বাচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে দ্রুত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোজ খবর নেয়া হচ্ছে। ঘটনা সত্য হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।