ফকিরহাটে কারেন্ট পোকার আক্রমণে শতশত কৃষককের উঠতি ধানের ব্যাপক ক্ষতি

পি কে অলোক,ফকিরহাট

আপডেট : ১২:৪৯ এএম, রোববার, ১ মে ২০২২ | ৫৮৫

মাঠে ধান পাঁকার অপেক্ষার প্রহর গুনছেন কৃষক। এমন সময় ফকিরহাটে কারেন্ট পোকা (বিপিএইচ) ও নেক ব্লাস্টার আক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আধা-পাঁকা ধানে কারেন্ট পোকার হঠাৎ আক্রমণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন শতশত কৃষক। সময় মতো স্থানীয় কৃষি অফিসের পরামর্শ ও সহায়তা না পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেক কৃষক। এ পরিস্থিতিতে চাষীরা দিশেহারা হয়ে কেউ কাঁচা ধান কাটছে, আবার কেউ ক্ষোভে দুঃখে মাঠেই ফেলে রেখেছে আক্রান্ত ধান।


উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ফকিরহাট উপজেলায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছর বোরো মৌসূমে ৮ হাজার ৩৯৮ হেক্টর জমি আবাদ ও ৩৯ হাজার ৬৫৩ মে. টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। উপজেলায় হাইব্রিড ধান ৭হাজার ৫০০ হেক্টর এবং উফসি জাতের ধান ৮৫০ হেক্টর আবাদ করা হলেও স্থানীয় জাতের ধান আবাদ হয়নি। এই জাতের ধান আবাদের জন্য ৫ হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন থাকলেও বাস্তবে তা আবাদ হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।


উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বেশ কিছু ব¬কের কৃষকেরা জানান, বোরো মৌসূমে কৃষি অফিস হাইব্রিড জাতের ধান রোপনের পরামর্শ ও উৎসাহ যুগিয়েছে। বর্তমানে এ সকল ধানে কারেন্ট পোকার ব্যাপক আক্রমণ হচ্ছে। এ বিপদের সময় প্রয়োজনীয় সহায়তা বা পরামর্শ দেওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের পাশে পাচ্ছেন না তারা। ব্লাস্ট ও কারেন্ট পোকার আক্রমণে অন্যের জমিতে বর্গা চাষি ও ঋণগ্রস্থ প্রান্তিক চাষিরা সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন।

তবে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার দাবী, কারেন্ট পোকার আক্রমণ ততটা মারাত্মক আকার ধারণ করেনি ফকিরহাটে। পোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে তিনি জানান।


উপজেলার ফকিরহাট সদর, বাহিরদিয়া-মানসা, পিলজংগ, বেতাগা, শুভদিয়াসহ ৮টি ইউনিয়নের প্রায় সব স্থানে ব্লকেই কারেন্ট পোকার আক্রমণ ও ব্লাস্টে ফসল নষ্ট হওয়ায় তাদের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষকেরা। তবে কৃষি অফিসের দাবী, তাদের নির্ধারিত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে।

উপজেলার ছোটবাহিরদিয়া গ্রামের ৫ নং ওয়ার্ড, সদর ইউনিয়নের সাতশৈয়া বিল, জাড়িয়ার বিল, মুচি ভিটা, সিংগাতির বিল, সাতাইরে মাঠ, তেলির পুকুর বিল, পিলজংগের বৈলতলী নওয়াপাড়া সাতবাড়য়া ও লখপুরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি মাঠে গিয়ে দেখা যায় খেতের বিতীর্ণ এলাকা কারেন্ট পোকার আক্রমণে ধুসর রং ধারণ করেছে। বাহিরদিয়া-মানসা ইউনিয়নের শতাধীক কৃষকের খেতে কারেন্ট পোকা আক্রমণে ধান নষ্ট হয়ে গেছে। সাতশৈয়া-জাড়িয়ায় প্রায় অর্ধশতাধিক চাষি, পিলজংগ সহ বিভিন্ন বিলের অনেক চাষির ধানেও এ পোকার আক্রমণ লক্ষ করা গেছে। বিপিএইচ বা বাদামী গাছফড়িং এর ভয়াবহ আক্রমণে দ্রুত ফসল হানির জন্য স্থানীয় কৃষকরা এ পোকার নাম দিয়েছেন কারেন্ট পোকা।

বাহিরদিয়া ইউনিয়নের কৃষক শেখ আহম্মদ আলী বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে জানান, কারেন্ট পোকার আক্রমণে দুই দিনের ব্যবধানে তার আড়াই বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক ধান গাছের গোড়া পঁচে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। আশে পাশের কয়েকটি খেতেও আক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের পরামর্শে কীটনাশক দিচ্ছেন কিন্তু তাতে খুব বেশি লাভ হচ্ছে না।


সদর ইউনিয়নের জাড়িয়ার বিলের বর্গা চাষি মাহফুজ শেখ বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, তিনি সাড়ে তিন বিঘা জমি হাড়ি (বর্গা) নিয়ে ধান চাষ করেছেন। জমি, সেচ, সার, ওষুধ মিলে প্রায় ৯০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তার পুরো জমিতেই কারেন্ট পোকা লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে কাচা ধান কাটছেন। এতে তার ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার ক্ষতি হবে বলে তিনি জানান। ফলে ঋণ শোধ করা নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন। পিলজংগের তেলির পুকুর এলাকা হোসেন শেখের ২ বিঘা জমিতে কারেন্ট পোকা লেগেছে। খেতের মাঝখানে বেশ কিছু অংশের ধানের গোড়া পঁচে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ ক্ষতির মূখে পড়ে তিনি ক্ষোভে দুঃখে আক্রান্ত ধানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। এ সময় আশে পাশে থাকা লোকজন আগুন নিভিয়ে ফেললে সমস্ত ধান খেত পুড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়।

পিলজঙ্গ ইউনিয়নের বৈলতলী গ্রামের আব্দুল হাই হাওলাদার, নওয়াপাড়ার মনিজ্জামান ফকির, নজরুল ইসলাম, বৈলতলীর আকবর হাওলাদার, আকরাম মোড়ল, আরব মোড়ল সহ বেশ কয়েকজন কৃষক বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে জানান, কারেন্ট পোকায় তাদের মতো উপজেলার প্রায় সব গ্রামের চাষীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। একই কথা বলেন ছোট বাহিরদিয়া গ্রামের কৃষক মোস্তফা হাসান, হিরু মিয়া, ওসমান ফকির প্রমুখ। তাদের অভিযোগ বোরো ধানে পোকা ও ব্লাস্ট আক্রমনের এই সংকটময় সময়ে স্থানীয় কৃষি অফিসের কোন সহায়তা পাননি তারা।

ফকিরহাট সদর ইউনিয়নের সদ্য বাবা হারানো কলেজ ছাত্র শেখ সুমন আলী বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, বাবার মৃত্যুর সপ্তাহ না যেতেই তাদের ২০ কাঠার মধ্যে ১৭ কাঠা জমিতে কারেন্ট পোকা লেগে ধান নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষি অফিসের কাউকে না পেয়ে বাজারের দোকান থেকে বিষ কিনে খেতে ছিটিয়েছেন তিনি। দরিদ্র সংসারে এ ক্ষতি হওয়ায় তিনি ভেঙে পড়েছেন। তাঁর দাবী কৃষি কর্মকর্তারা শুধু প্রদর্শনীর খেত গুলোতে গিয়ে ছবি তোলেন। তাদের মত গরিব কৃষকদের খেতে গিয়ে পরামর্শ বা সহায়তা দেন না।


এ বিষয়ে বিভিন্ন ব্লকের একাধিক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলে তারা সপ্তাহে ৪ দিন মাঠে গিয়ে নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছেন বলে দাবী করেন। কৃষকদের ওষুধের দোকানে না গিয়ে তাদের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন কৃষি কর্মকর্তারা।

স্থানীয় কৃষি অফিসের উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা নয়ন কুমার সেন বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে জানান, তিনি মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের পরামর্শ প্রদান করছেন। ক্ষতির পরিমান কমিয়ে আনতে কৃষি অফিস কাজ করছে বলে তিনি জানান।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নাছরুল মিল্লাত বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, কৃষকদের পরামর্শ ও সহায়তার জন্য কৃষি অফিস তৎপর রয়েছে। তিনি কৃষকদের কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ধান রোপনের সময় কিছুদুর অন্তর একটি করে সারি ফাঁকা দিলে পোকার আক্রমণ কম হবে। এছাড়া তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে কারেন্ট পোকার আক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি জানান।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত