মেজর জিয়া উদ্দিনের মৃত্যুর পর মৎস্যজীবিদের মধ্যে অজানা আতংক

সুন্দরবনের চরাঞ্চল নিয়ন্ত্রণে শক্তির লড়াই শুরু

মংলা সংবাদদাতা

আপডেট : ০৯:৪৭ এএম, রোববার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ | ৯৬৫

সুন্দরবন

সুন্দরবনের দুবলা চরাঞ্চল সংলগ্ন সাগর উপকূলের মাছ আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়া করণের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে একটি প্রভাবশালী মহল মরিয়া হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবন সাব সেক্টর কমান্ডার, দুবলার ফিশার ম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট মৎস্য ব্যবসায়ী মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিনের মৃত্যুর পর সুন্দরবনের মাছের ব্যবসা স্বাধীনতা বিরোধী একটি চক্রের দখলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে এ চক্রটি শুঁটকী উৎপাদনে চরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে অনেকটা পেশি শক্তি ও ক্ষমতার দাপটের লড়াই শুরু করেছে। চক্রটি সাগর পাড়ের বিশাল শুঁটকী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য নানা অপতৎপরতা শুরু করেছে। এতে করে মৌসুম শুরুর আগেই জেলে ও শুঁটকী ব্যবসায়ীদের মধ্যে অজানা আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। আর এ কারণে দুবলার জেলে ও শুঁটকী ব্যবসায়ীদের মধ্যে নানা শংকা বেড়েই চলছে। এবারের মৌসুমে ব্যাপক অরাজকতার আশংকায় অনেক মৎস্যজীবিই মাছ আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়ায় দুবলার চরে আসবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

দুবলার জেলে ও শুঁটকী ব্যবসায়ীরা জানান, সুন্দরবনের রাজস্ব আয়ের অন্যতম খাত হচ্ছে দুবলার শুঁটকী প্রক্রিয়া করণ চরাঞ্চল। এখানে প্রতিবছর মৌসুমে কোটি কোটি টাকা মূল্যের শুটকী উৎপাদিত হয়ে থাকে। প্রতি অক্টোবর থেকে ফ্রেব্রুয়ারী পর্যন্ত টানা ৫ মাস জেলে ও ব্যবসায়ীসহ হাজারো পেশাজীবী মানুষের সমাগম ঘটে থাকে দুবলায়। অন্তত ৩০ হাজার জেলে ও মৎস্যজীবির জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে সাগরে মাছ আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণকে ঘিরে।

দুবলার চরের মৎস্যজীবিরা জানান, মেজর জিয়াউদ্দিন দুবলা ফিসার ম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে গত প্রায় ৩৪/৩৫ বছর ধরে দুবলার চরসহ সুন্দরবন উপকূলে শীতকালে শুঁটকী মাছ আহরণসহ বছর ব্যাপী বঙ্গোপসাগরে সুন্দরবন উপকূলের মাছ ব্যবসার প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী ছিলেন। এ ব্যবসায় মরহুম জিয়ার পাটর্নার ও সহযোগী ছিলেন তাঁর ভাই মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন, ভাগ্নে শাহনুর রহমান শামীম প্রমুখ। এ ছাড়া কক্সবাজার এলাকার জগন্নাথ বহরদার, সাবের বহরদার, অনীল বহরদার, খুলনার মাসুম চৌধুরী, মংলার বুলবুল ইজারাদার প্রমুখ ব্যবসা করতেন।

দুবলার চরে দীর্ঘ কয়েক বছর মৎস্য ব্যবসা করেন এমন কয়েকজন প্রবীন মৎস্যজীবি জানান, ১৯৮২ সালের দিকে মেজর জিয়ার পাশাপাশি খুলনার খান সফিউল্লাহ খোকন নামের এক ব্যক্তি সুন্দরবনে দুবলার চরে চিংড়ি ব্যবসা ও আস্তে আস্তে মাছের ব্যবসা এবং শুটকী মাছ পরিবহনের ব্যবসা শুরু করে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে অন্য এক প্রভাবশালী মাছ ব্যবসায়ীকে সঙ্গে নিয়ে তাদের দু’জনের প্রভাব ও সুন্দরবনে অবস্থানকারী বিভিন্ন প্রশাসনের সহায়তায় আলোরকোল চরের সমস্ত মাছের ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে নেন খোকন। এক পর্যায়ে খোকন দুবলা ফিশার ম্যান গ্রুপের অন্যতম কর্মকর্তা হিসাবে নিজের প্রতিপত্তি ও প্রভাব সংহত করেন। সুন্দরবন উপক’লের ডুমরিয়া, বটিয়াঘাটা, কয়রা, দাকোপ, রামপাল প্রভৃতি এলাকায় ক্ষুদ্র মৎস্য ব্যবসায়ী ও জেলেরা খোকনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে কেউ কেউ সুন্দরবনের সাগরে মৎস্য আহরণে নিয়োজিত হয়েছেন।

কয়েকজন জেলে মহাজন অভিযোগ করে বলেন, দাদন ব্যবসা, বন বিভাগের রাজস্ব ফাঁকি, ছোট মাছ ব্যবসায়ীদের ভাগের টাকা মেরে দেয়া, জলদস্যু-বনদস্যুদের সাথে যোগসাজসে জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়সহ অবৈধ পথে এই ব্যক্তি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এই অর্থ পুঁজি হিসাবে খাটিয়ে দুবলার চরের মৎস্য ব্যবসায়ও তিনি তার অবস্থান শক্তিশালী করেন। মেজর জিয়ার জীবিত অবস্থায় দুবলার চরসহ সুুন্দরবনে সফিউল্লাহ খোকন কখনই প্রকাশ্যে দাপট বা দৌরাত্ম না দেখালেও তাঁর মৃত্যুর পর খান সফিউল্লাহ খোকন সেখানে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করার সকল বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন। ইতিমধ্যে মরহুম মেজর জিয়ার ঘনিষ্ঠ ও আত্মীয়-স্বজনকে দুবলার চর থেকে উৎখাত করার চক্রান্ত শুরু করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি খুলনা ও সাতক্ষীরা এলাকার দুর্ধর্ষ ক্যাডারদের সুন্দরবন ব্যবসায় নিয়োজিত করার চক্রান্ত করেছেন। যাতে এ ক্যাডার বাহিনী সুন্দরবনে মেজর জিয়ার অবর্তমানে অবস্থান নিয়ে মৎস্য ব্যবসার আড়ালে অস্ত্র প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ভান্ডার হিসাবে সুন্দরবনের গহীন অরণ্য ব্যবহার করতে পারে। সুন্দরবনে মেজর জিয়ার অবর্তমানে সফিউল্লাহ খোকনের এ অপতৎপরতার কারনে দুর্গম চরাঞ্চলটি অপরাধী চক্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার আশংকা করছেন দুবলার জেলে ও শুটকী ব্যবসায়ীরা।

এদিকে পাকিস্তান আমলে ছাত্র জীবনে মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন এন.এস.এফ এর সক্রিয় সদস্য ও তৎকালীন মুসলীম লীগ নেতা খান এ সবুরের আস্থাভাজন লোক খান সফিউল্লাহ খোকনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং আগে পরে নানা বিতর্কিত কর্মকান্ড সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি এক সময়কার খুলনার বহুল আলোচিত রাজনীতিবিদ নিহত আবুল কাশেম, পরবর্তিতে তার ভাতিজা সন্ত্রাসী লিটু ও এরশাদ শিকদারের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে খুলনাসহ সুন্দরবনে ব্যাপক আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার করেন। তার বিরুদ্ধে খুলনার ৫ নং ঘাট এলাকায় মো. চাঁন মিয়া ও ৪নং ঘাটের চিংড়ি ব্যবসায়ী নুরুল হক (চিংড়ি নুরু) মাছের ডিপোর মালিকানা জবরদস্তভাবে লিখে নেবার অভিযোগও রয়েছে।

১৯৮০ সন হতে ১৯৯০ সন পর্যন্ত খোকন খুলনার দক্ষিণ অঞ্চল যেমন ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, চালনা, কয়রা, বটিয়াঘাটার হাজার হাজার বিঘা চিংড়ি মাছের ঘের দখল করে এবং কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেন। ২০০২ সালে অপারেশন কিন হার্টের সময় নানাবিধ অভিযোগের প্রেক্ষিতে সে যৌথ বাহিনীর হাতে আটকও হয়েছিলেন।

তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ, বর্তমান সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে তিনি স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা, গুন্ডা ও মাস্তান বাহিনী দিয়ে তার নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের মামলা না দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে।


এ ব্যাপারে খান সফিউল্লাহ খোকনের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, দুবলার চরে মৎস্য ব্যবসার প্রেক্ষিতে তার নানা প্রতিপক্ষ রয়েছে। তিনি তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এ সবই ব্যবসায়িক চক্রান্ত। তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য মিথ্যা অপবাদ দেয়া হচ্ছে। তিনি কোন ধরনের বেআইনী কর্মকান্ডের সাথে কখনও জড়িত ছিলেন না এবং এখনও নেই।

কয়েকজন মৎস্যজীবি জানান, বর্তমানে স্বাধীনতা বিরোধী এ চক্রের দখলে দুবলার চরের শুঁটকি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। মংলার মৎস্য ব্যবসায়ী শাজাহান খান, আবুল বাশার, আলম শেখ ও রামপালের মৎস্য ব্যবসায়ী দিপক সরকার, অচিন্ত মন্ডল, জালাল উদ্দিন, চুন্নু মিয়াসহ অনেক ব্যবসায়ী আশংকা করেছেন যে, মেজর জিয়ার মৃত্যুর পর দুবলার চরের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বড় ধরনের দ্বন্ধ সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে তারা এবারের মৌসুমে মৎস্যজীবিরা যাতে সুষ্ঠুভাবে মাছ আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়া করতে পারে তার জন্য আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনের কঠোর নজরদারীর দাবি জানান।

প্রয়াত মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিনের ছোট ভাই ও দুবলা ফিশার ম্যান গ্রুপের নেতা মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন জানান, আসন্ন শুটকী মৌসুমের সমুদ্র যাত্রার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন জেলেরা। তবে দুবলার চলাঞ্চলে যাতে কোন প্রকার বিশৃংখলা কিংবা অপশক্তির আগ্রাসন জেলেরা মেনে নেবেন না। তিনি আরও বলেন, আসন্ন মৌসুম নিয়ে ব্যবসায়ীদের একটি মহল অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এ ব্যাপারে পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মাহমুদুল হাসানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এবারের শুঁটকি মৌসুমে যাতে কোন ধরনের অরাজকতা অথবা সংঘাত সৃষ্টি না হয় সে জন্য বন বিভাগের পাশাপাশি বিভিন আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সজাগ দৃষ্টি রাখছে।

কোষ্টগার্ড পশ্চিম (মংলা) জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লেঃ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, শুঁটকি মৌসুমে যাতে কোন সংঘাত ছাড়াই মৎস্যজীবিরা সুষ্ঠুভাবে মাছ আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়া করতে পারে সে জন্য কোষ্টগার্ড সদস্যরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। সেখানে কোন অবস্থাতেই অপশক্তিকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত