৩৫ বিঘা জমি দেখিয়ে দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র

মোংলায় জাল দলিল করে ২৫ কোটি টাকার জমি রেজিষ্ট্রি, দলিল জব্দ

মাসুদ রানা, মোংলা

আপডেট : ১২:০৮ এএম, রোববার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২২ | ৮৩৩

মোংলায় জালিয়াতির মাধ্যমে অন্যের মালিকানাধীন জমির জাল দলিল রেজিষ্ট্রি করে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ‘ডরিন পাওয়ার হাউজ এন্ড টেকনোলজিস লিঃ’ এর বিরুদ্ধে। মোংলার বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের সানবান্দা এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত সরকারি এক আমলা (যুগ্ম সচিব) আব্দুস সাত্তার মিয়ার ৩৫ বিঘা জমি দালাল চক্র ডরিন প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া মালিক সেজে জাল দলিল করে দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকা। এ জাল দলিল হয়েছে ডরিন পাওয়ার হাউজ এন্ড টেকনোলজিস লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঝিনাইদাহ-০২ আসনের এমপি তাহজীব আলম সিদ্দিকীর নামে। দালালদের সহায়তায় ভূয়া মালিক সেজে ওই প্রতিষ্ঠানকে অন্যের জমির জাল দলিল রেজিষ্ট্রি করে দিয়েছেন বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার দেহেরগতি পূর্বপাড়ার বাসিন্দা মোঃ আব্দুল সত্তার হাওলাদার নামের এক ব্যাক্তি। তবে জালিয়াতি করে জমি রেজিষ্ট্রি করার ঘটনা জানতে পেরে দলিলটি জব্দ করেছে উপজেলা প্রশাসন।


এদিকে এই জাল দলিল বাতিলের জন্য ইতিমধ্যে আদালতে মামলা করেছেন ক্ষতিগ্রস্থ ও জমির প্রকৃত মালিক অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব আব্দুস সাত্তার মিয়া। আব্দুস সাত্তার মিয়া বাদী হয়ে গত ১৬ ফেব্রুয়ারী বুধবার বাগেরহাট আদালতে এই মামলা দায়ের করেন। এব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইলে তার জমি জালজালিয়াতির মাধ্যমে কারা প্রতারনা করেছে তাদের আদালতের মাধ্যমে ব্যাবস্থা গ্রহন করবে এবং তারপর গণমাধ্যম কর্মীদের মুখোমুখি হবেন বলে জানান তিনি।


ভূয়া মালিক সেজে জালিয়াতির মাধ্যমে অন্যের জমি বিক্রি ও রেজিষ্ট্রি করে দেয়ার ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের মাঝে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। এমন কান্ডে সর্বমহলে প্রশ্ন উঠেছে, সাব রেজিষ্ট্রার সচেতন থাকায় কিভাবে জালিয়াতি করে অন্যের জমির মালিক সেজে বিক্রি ও রেজিষ্ট্রি করে দিয়ে প্রতারক মোঃ আব্দুল ছত্তার হাওলাদার। তবে কি সাব রেজিষ্ট্রার নিজেই জড়িত ? এমন প্রশ্ন সচেতন মহলের। এ দলিল করে প্রতারক দালাল হাসমতসহ এ চক্রের সদস্যরা হাতিয়ে নিলো প্রায় দেড় কোটি টাকা।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৫ ডিসেম্বর উপজেলার বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের সানবান্দা গ্রামের সানবান্দা মৌজার অবসরপ্রাপ্ত সরকারী আমলা আব্দুস সাত্তার মিয়ার প্রায় ৩৫ বিঘা জমি জালিয়াতি করে জাল দলিল করা হয়। দালাল চক্রের মুল হোতা মোংলা পৌর শহরের গিয়াসউদ্দিন সড়কের বাসিন্দা মোঃ হাসমত আলী, রিয়াদ, বাচ্চু শেখ, শরিফুল শেখ ও আব্দুল্লাহ হাওলাদারসহ একটি চক্র প্রকৃত মালিক আব্দুস সাত্তার মিয়ার জায়গায় বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মোঃ আব্দুল ছত্তার হাওলাদারকে দিয়ে ওই জমি ডরিন পাওয়ার হাউজ এন্ড টেকনোলজিস লিঃ এর কাছে বিক্রি করান। যেখানে ২৫ কোটি টাকা মুল্যের এ জমি ১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা দলিল মূল্যে ওই জমির রেজিষ্ট্রি হয়। ডরিন পাওয়ার হাউজ এন্ড টেকনোলজিস লিঃ’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাহজীব আলম সিদ্দিকীর নামে রেজিষ্ট্রি হয় জমিটি। তাহজীব আলম সিদ্দিকী ঝিনাইদাহ-০২ আসনের বর্তমান এমপি বলে জানায় তার প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী মনজুরুল নাসির।


এ বিষয়ে এমপি তাহজীব আলম সিদ্দিকী দেশের বাইরে অবস্থান করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী মনজুরুল নাসিম বলেন, মোংলার দালাল হাসমত আলী ও বাগেরহাটের রিয়াদ চক্রের খপ্পড়ে পড়ে আমরা প্রতারণার শিকার হয়েছি, তারা আমাদের এই জমি দেখিয়ে ভুয়া মালিক সাজিয়ে জমি কিনে দিয়েছেন এবং এর জন্য যাারাই আমাদের জমি কিনে দেয়ার জন্য মোংলায় নিয়েছে এবং জমি দেখিয়ে রেজিষ্ট্রি করে দেয়ার ব্যাবস্থা করেছে তারাই দায়ী। কারণ আমরা তো তাদেরকে জমির টাকা দিয়েছি। সাব রেজিষ্ট্রার কাগজ পত্র যদি সঠিক ভাবে যাচাই-বাছাই করতো তবে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পরতে হতোনা এ প্রতিষ্ঠানের। আমাদের প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট একাত্রিত হয়ে তাদের (দালালদের) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিবেন বলেও জানান তিনি।


এব্যাপারে জালজালিয়াতি চক্রের অন্যতম সদস্য হাসমত আলীর কাছে ফোনের মাধ্যমে জমি রেজিষ্ট্রির বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি এক পর্যায় স্বীকার করে বলেন, এর সাথে আমি একা জড়িত নয়, সাব রেজিষ্ট্রারসহ আরো অনেকে, এনিয়ে সামনাসামনি কথা বলবো বলে ফোন রেখে দেন। আর অপর দালাল রিয়াদকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। তবে জাল দলিল করার বিষয় প্রতারক চক্রে মোংলা ও বাগেরহাটের বেশ কয়েকজন জড়িত বলে জানায় হাসতম আলী।


মোংলা উপজেলা সাব রেজিষ্ট্রার মোঃ জুবায়ের হোসেন বলেন, ডরিন পাওয়ার হাউজ এন্ড টেকনোলজিস লিঃ এর নামে জমিটির দলিল রেজিষ্ট্রি হয়ে যাওয়ার পরে জানতে পেরেছি যে ওই কথিত দলিলটি জাল হয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন মাধ্যমে জালজালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে দলিলটি জব্দ করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট দলিল লেখক (মহুরী) সমিতির সভাপতি আবুল কালাম শেখকে গত ২৬ জানুয়ারী কারণ দর্শানো নোটিশ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি কোন সৎ উত্তর দিতে পারেননি তিনি। যার জন্য আপাতত উপজেলা সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে দলিল লেখা বা অফিস কার্যালয় না আসার জন্য তাকে নিষেধ করা হয়েছে।


দলিল লেখক আবুল কালাম শেখ বলেন, দলিল তৈরীর পর রেজিষ্ট্রির আগ মুহুর্তে সমুদয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব সাব রেজিষ্ট্রারের। কোনটা জাল বা কোন মালিক ভুয়া সেটি দেখার দায়িত্ব সাব রেজিষ্ট্রারের, কিন্তু তিনি সেটি পুংখানুপুঙ্খভাবে না দেখে উল্টো আমাকে অভিযুক্ত করে কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছেন। তবে যারা এ দলিল লেখানোর জন্য আমাদের ভুয়া কাগজ পত্র দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়ারও দাবি জানায় তিনি।

অপরদিকে জালজালিয়াতি প্রক্রিয়ায় ডরিন পাওয়ার হাউজ টেকনোলজিস লি: এর নামে যে দলিল হয়েছে তার বাজার মূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা হলেও দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র এক কোটি ৪৩ লাখ টাকা। জালজালিয়াতি করে দলিল রেজিষ্ট্রি করিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেয়া প্রায় দেড় কোটি টাকার পুরোটাই দালালচক্র ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে আতœসাৎ করেছেন। এরপর জাল দলিলের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দিতে দালাল চক্রের মূল হোতা হাসমত আলী ও রিয়াদসহ অন্যান্যরা নানা অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।


নাম প্রকাশ না করা শর্তে কয়েকজন ভুক্তভোগী বলেন, শুধুই ১৫ ডিসেম্বরের এ জাল দলিলই নয় সাব রেজিষ্ট্রার ও দালাল হাসমতের বিরুদ্ধে এমন জালজালিয়াতির আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে। জমি কেনা-বেচা ও সরকারী চাকুরী দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে হাসমত বহু মানুষের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রতারণা করে আসছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তার এমন কর্মকান্ডের কারণে বিভিন্ন সময়ে উপজেলা ভূমি ও সাব রেজিষ্ট্রি কার্যালয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে বহাল তবিয়তে থাকছেন তিনি। প্রতারক হাসমত গং চক্রের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবী ভুক্তভোগীদের।

মোংলা উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার (ভূমি) কমলেশ মজুমদার বলেন, জাল দলিলের বিষয়টি আমি জানার পর ওই দলিলটি জব্দ করা হয়েছে এবং যেহেতু বিষয়টি জেনেছি সেহেতু এ দলিলের নামপত্তন/নামজারি হবেনা সেটি বন্ধ করা হয়েছে। এ ঘটনায় একটি মামলাও হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। ঘটনাটি সাব রেজিষ্ট্রার জুবায়ের হোসেন আমাকে বললে আমি তাকে উভয় পক্ষকে ডাকতে বলেছি, তবে তারা গাঁ ডাকা দিয়েছে। এছাড়া এ জালজালিয়াতির ঘটনায় দালাল হাসমতসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান ইউএনও। তিনি আরো বলেন, এসব অভিযোগের কারণেই অনেক আগে থেকেই হাসমতসহ তার প্রতারক চক্রকে এসিল্যান্ড (ভুমি অফিস) ও আমার (ইউএনও) অফিসে আসা বন্ধ করা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত