সম্ভাবনাময় বাগেরহাট

ইমরুল কায়েস

আপডেট : ০২:০৯ পিএম, রোববার, ৭ জানুয়ারী ২০১৮ | ১৯৯২

‘‘সুন্দরবনে বাঘের বাস
দড়াটানা ভৈরব পাশ
সবুজে শ্যামলে ভরা,
নদীর বাঁকে বসতো যে হাট
-তার নাম বাগেরহাট।’’

কবি আবু বকর সিদ্দিকের এই লেখাতেই ফুটে ওঠে ঐতিহাসিক বাগেরহাটের ভৌগোলিক পরিচিতি।

“বাগেরহাট”। বাংলাদেশের দণি-পশ্চিম কোণের উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট যা প্রাচীণ সমতটের একটি জনপদ। বাগেরহাট নামটির সাথে মিশে আছে হযরত খান জাহান (রহ:) এর (‘খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান’) স্মৃতিবিজড়িত গৌরবময় কীর্ত। মধ্যযুগে নির্মিত মুসলিম স্থাপত্যের এ নিদর্শন গুলো এখন বিশ্বঐতিহ্যের অংশ।


খুলনা জেলার দেিণ প্রাচীন ভৈরব নদীর বাঁকে মুসলিম-পূর্বযুগের বসতিস্থলে পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে ‘খালিফাতাবাদ’ নামে গড়ে ওঠা এই জনপদটিই বর্তমানে ‘বাগেরহাট’ নামে পরিচিত। এ জেলার আর এক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিশ্বঐতিহ্য পৃথিবী বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। রয়েছে বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ দেশের ২য় সমুদ্র বন্দর- মোংলা বন্দর, ‘হোয়াইট গোল্ড’ খ্যাত চিংড়ি, নারিকেল তৈল এসবের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে বরাবরই গুরুত্বপুর্র ভুমিকা রেখে চলেছে বাগেরহাট জেলা।


একটি সমুদ্র বন্দর, একটি বিমান বন্দর, সড়ক পথে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, রেল যোগাযোগ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিশ্ব ঐতিহ্যে আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এই উপাদানগুলো যে স্থানে রয়েছে সে অঞ্চল অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যে কতটা শক্তিশালী তা বলার আর অপেক্ষা রাখেনা। পদ্মা সেতু, খুলনা-মোংলা রেল যোগাযোগ প্রকল্প, প্রস্তাবিত খানজাহান আলী বিমানবন্দর, রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্তের কারনে বাগেরহাট দিনদিন বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিনত হতে শুরু করেছে। সমৃদ্ধি খুব দূরের পথ নয়, এমনটাই এখন ভাবছেন সবাই।


সম্প্রতি (২০১৭ মে) অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বাগেরহাট ভ্রমনে এসে বলেছেন, “বাগেরহাট এখন একটি ‘বিগ আরবান এরিয়া’ হয়ে গেছে। বাগেরহাট অনেক বেশি পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকা। আমাদের কৃষি নির্ভর জাতীয় অর্থনীতিতে বাগেরহাট একটা ভূমিকা পালন করছে। আর রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান হয়ে গেলে এই এলাকাটি একটা ‘পাওয়ার হাব’ হয়ে যাবে।”


৬০ বছরের অধিক পুরানো সমুদ্র বন্দর মোংলা বন্দর এই বাগেরহাট জেলাতেই কিন্তু তারপরও জেলাটি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত, অনগ্রসর। লোকশানে জর্জরিত বন্দরটি লাভের মুখ দেখেছে। অতীতে যে কোন সময়ের চেয়ে বন্দরে রেকর্ড পরিমান বৈদেশিক জাহাজের আগমন ঘটছে। চুক্তি অনুযায়ী ভারত ও নেপাল মোংলা বন্দর ব্যবহার শুরু করলে দ্রুত এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন জাগরণ ঘটবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা । পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু, সম্প্রতি মোংলা ঘষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌ চ্যানেল দিয়ে পুনরায় জাহাজ চলাচল শুরু, প্রস্তাবিত রেল, বিমান ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসছে বাগেরহাট।

বাগেরহাট জেলা বরাবরই দেশী বিদেশী পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষনীয়। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবনের বৃহতাংশ এই জেলাতেই অবস্থিত। সারা বছরই সুন্দরবনে বিদেশী পর্যটকের আনাগোনা থাকে। আর শীত মৌসুম যেন হয়ে ওঠে বিদেশী পর্যটকদের মিলন মেলা।

প্রতœতক অধিদপ্তর (খুলনা) কাষ্টোডিয়ান গোলাম ফেরদৌস বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, বাগেরহাটের অন্যতম আকর্ষন রয়েছে প্রায় সাড়ে ৬০০ বছর পুরাতন ষাটগম্বুজ মসজিদ। সম্প্রতি এই প্রত্নতাত্তিক স্থাপনার সৌন্দর্যবর্ধন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পর্যটকদের আবাসন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাসহ সংশ্লিষ্ট কিছু উন্নয়ন কাজ শেষ হয়েছে। এর ফলে মসজিদ অফুরন্ত পর্যটন সম্ভবনার সম্পদ ঐতিহ্য ও নানা বৈচিত্রময় প্রতœসম্পদ, সাং¯কৃতিক সম্পদ, নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ বাগেরহাট অঞ্চল আরও প্রসিদ্ধ হবে বাড়বে রাজস্ব আয় ও। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাগেরহাট থেকে প্রত্তত্ব বিভাগ ৭০ লক্ষ টাকার বেশি রাজস্ব আয় করেছে । ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্য ধরা হয়েছে।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকতা বলেন,পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে পর্যটন খাত থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ থেকে রাজস্ব আয় হয় ৮২ ল ৬১ হাজার ৬শ’ ১০ টাকা যা চলতি অর্থ বছরে কোটি টাকা ছাড়াবে আশা করছে বন বিভাগ।

বাগেরহাট মৎস্য বিভাগের বিভাগীয় মৎস্য কর্মকর্তা (ডিএফও) জিয়া হায়দার বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, সল্প সময়ে চিংড়ি চাষ হতে ৩-৪ গুন মুনাফা পাওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিনিয়োগকারীরা এই জেলায় এসে চিংড়ি চাষে বিনিয়োগ করছে। গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) জেলায় ৩৫ হাজার ৫৮৪টি বাগদা চিংড়ি খামার ও ৪০ হাজার ৯৪৮টি গলদা চিংড়ি খামার থেকে মোট ২৯ হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন চিংড়ি (বাগদা ও গলদা) উৎপাদন হয়। এ জেলার উৎপাদিত চিংড়ির ৯০% বিদেশে রপ্তানী করা হয়। যা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে।

বাগেরহাট সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহা. আনিসুজ্জামান মাসুদ বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, মোংলা বন্দরের কারনে বাগেরহাটে দিনদিন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাগেরহাট সড়ক বিভাগের আওতাধীন ৪৯৬ কিলোমিটার সড়ককে সবসময় প্রস্তুত রাখা হয়েছে পদ্মাসেতুর নির্মান কাজ শেষ হবার পর বাগেরহাট দেশের একটি গুরত্বপুর্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসাবে গুরুত্ব পাবে।

বাগেরহাট বিসিক শিল্প নগরীর উপ-ব্যবস্থাপক হাজরা সিদ্দিকুর রহমান বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, এশিয়ার দেশসমুহে নারিকেল তেলের বিশেষ কদর রয়েছে। বাগেরহাট শহর বাগেরহাট বিসিক শিল্প নগরীতে অবস্থিত ৪৪টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নারিকেল তেলের মিল রয়েছে ২২টি। আর সব মিলিয়ে জেলায় রয়েছে ৬০টি নারিকেল তেলের মিল। এসব মিলের মোট নারকেল তেলের উৎপাদন প্রায় ৫ হাজার মেট্রিক টন।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, বিগত কয়েক বছরে দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন হয়েছে এবং অনেক উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে এ জেলার অনেক কিছু বদলে যাবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলে শিল্পকারখানার বিকাশ ঘটবে। ইতিমধ্যে মোংলা বন্দর সংলগ্ন এলাকায় দেশের অধিকাংশ বড় বড় বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান জায়গা কিনে তাদের ব্যবসা সম্প্রাসারনে কাজ করে যাচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের মতো মোংলা বন্দর সমানতালে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। রেলপথ, বিমানবন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শেষ হলে বাগেরহাট হবে ব্যবসায়ীদের আগ্রহের কেন্দ্র। ব্যবসার সাথে প্রাকৃতিক সেীন্দর্য উপভোগের কেন্দ্র হবে বাগেরহাট। পুরো বাগেরহাট জেলাই হতে পারে ইকো-টুরিজমের এক পরিচ্ছন্ন নগরী।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত