চোখে-মুখে হতাশা জেলে-মহাজনের

সাগরে মিলছে না ইলিশের দেখা

মহিদুল ইসলাম, শরণখোলা 

আপডেট : ০৫:২৯ পিএম, রোববার, ২২ আগস্ট ২০২১ | ৭৩৫

ইলিশের দেখা মিলছে না এবার সাগরে। চলতি সপ্তাহে ইলিশ শূন্য ট্রলার নিয়েই ঘাটে ফিরেছেন বাগেরহাটের শরণখোলার জেলেরা। মৌসুমের পাঁচ মাস পার হলেও এপর্যন্ত লাভের মুখ দেখেনি কোনো মালিক-মহাজন। সাগর থেকে উঠে আসার পর সবার চোখে-মুখে দেখা গেছে হতাশার ছাপ। এক ট্রিপে দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করে একটি ইলিশও জালে ধরা পড়েনি এমন ট্রলারও রয়েছে। কেউ কেউ পুঁজি হারিয়ে সাগরে ট্রলার পাঠাতে পারছেন না বলেও জানা গেছে।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো কানো ট্রলারের মাছ মাত্র সাড়ে সাত হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে। একেকটি ট্রলার সাগরে পাঠাতে খরচ হয়েছে দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকা। আর মাছ বিক্রিতে যা নেমেছে তাতে তেল খরচও ওঠেনি অনেক মহাজনের। লাখ লাখ টাকা লোকসানে রয়েছেন সবাই। এ কারণে মৎস্য পল্লীতেও নেই তেমন কর্মচঞ্চলতা। খা খা করছে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও মৎস্য আড়তগুলো।


এফবি জিসান ট্রলারের মালিক উপজেলা রাজৈর গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী মনির হাওলাদার বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে জানান, গত মঙ্গলবার তার ট্রলারটি ঘাটে ফিরে আসে। কিন্তু একটি ইলিশও পায়নি। কিছু বোতল (টুনা মাছ) ও অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ পেয়েছে শুধু। তা বিক্রি করেছেন মাত্র সাত হাজার টাকা। পুঁজি হারিয়ে এই গোনে তার ট্রলারটি সাগরে পাঠাতে পারেননি।

এফবি খায়রুল ইসলাম ট্রলারের মালিক কবির হাওলাদার বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে জানান, তিনিও দুই লাখ টাকা খাটিয়ে মাছ বিক্রি করেছেন মাত্র সাড়ে সাত হাজার টাকার। এভাবে অনেকেই লোকসানে পড়ে এই গোনে সাগরে যেতে পারেননি।

এফবি মুন্না ট্রলারের মাঝি মো. মিজান মিয়া হতাশা প্রকাশ করে বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, মোরা গহীন সমুদ্রে মাছ ধরি। গত মঙ্গলবার সাগর থেইক্যা উইড্যা আইছি। এই ট্রিপে খরচ ওইছে পৌনে দুই লাখা টাহা। যে মাছ পাইছি তা বেইচ্যা নামছে মাত্র ২২হাজার টাহা। ট্রলারে মোরা মাঝি-মাল্লা লইয়া ১৭জন। অ্যাহন মহাজনরে কি দিমু আর মোরাই বা কি নিমু!


শরণখোলা মৎস্য আড়তদার সমিতির সভাপতি মো. দেলোয়ার ফরাজী বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, সাগরের যে অবস্থা তাতে জেলে-মহাজনদের এবার ভিক্ষার ঝুলি নিয়া রাস্তায় নামা ছাড়া কোনো উপায় নাই। সাগরে কোনো মাছ নাই। একেক জন ট্রলার মালিক ও আড়তদার আট লাখ, দশ লাখ টাকা কইরা লোকসানে আছে। সামনের গোনে সাগরে নামার মতো পুঁজিও অনেকের কাছে নাই।


দেলোয়ার ফরাজীর অভিযোগ, ইলিশের ভরা মৌসুমের সময় ৬৫ দিনের অবরোধ থাকায় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে অবাধে মাছ ধরে নিয়ে গেছে। ভারতীয় জেলেরা সুন্দরবনের দুবলার চর থেকে মাত্র ২০-২৫ নটিক্যাল মাইল দূরত্বে এসে মাছ ধরে নিয়ে যায়। অবরোধের সময় মাছ না ধরলে সেই মাছটা এখন জেলেদের জালে ধরা পড়তো। যার ফলে, দেশীয় জেলেরা এখন লোকসান গুনছে।

বাংলাদেশ ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির বাগেরহাট জেলা শাখার সভাপতি মো. আবুল হোসেন বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, বাগেরহাট জেলায় ছোটবড় মিলিয়ে সহ¯্রাধিক ফিশিং ট্রলার রয়েছে। এর মধ্যে শরণখোলাতেই রয়েছে তিন শতাধিক ফিশিং ট্রলার। এবার কোনো ট্রলারেই ভালো ট্রিপ হয়নি। তেল খরচও উঠছে না অনেকের।

আবুল হোসেন জানান, বৈশাখ মাসে ইলিশ মৌসুম শুরু হয়। চলে আশ্বিন মাস পর্যন্ত। ইতোমধ্যে মৌসুমের পাঁচ মাস চলে গেছে। এর মধ্যে আবার দুই মাস (৬৫দিন) গেল অবরোধে। শুরুর একমাসে কয়েক দফা দুর্যোগে সাগরে জাল ফেলা যায়নি। তখন মাছও তেমন পড়েনি। আর অবরোধ শেষ হওয়ার পরও বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে দুই ট্রিপ হয়েছে। তাতে চালান ওঠেনি কোনো মালিকের।


ভারতের জেলেদের অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ করে এই মৎস্যজীবী নেতা বলেন, এখনো ভারতের জেলেরা আমাদের জলসীমানায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এবং ভারতে একই সময়ে অবরোধ না দিলে আমাদের জেলেরা ইলিশে মার খেতেই থাকবে। দেশীয় জেলেদের রক্ষা করতে এব্যাপারে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ।

শরণখোলা উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা এম এম পারভেজ বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে জানান, সাগরে ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র সব সময় একই অবস্থানে থাকে না। খাদ্য সংকট বা নিরাপদ আবাস্থল না পেলে তাদের গতি পরিবর্তন করে। জলবায়ু এবং ঋতুর পরিবর্তনের কারণেও এমনটা হতে পারে। যার ফলে, এবার চাঁদপুর ও কক্সবাজার এলাকায় প্রচুর ইলিশ পড়তে শোনা যাচ্ছে। তবে তিনি ভারতীয় জেলেদের বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে মাছ ধরার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত