সুন্দরবনে চলছে বাঘ-হরিণ শিকার, নেপথ্যে গডফাদার

স্টাফ রিপোর্টার

আপডেট : ১০:৩৪ পিএম, শনিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২১ | ৮৯৮

বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা সুন্দরবনে ভালো নেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবি চিত্রল হরিণ। এই দুইটি বন্যপ্রাণি চোরা শিকারী ও পাচারকারীদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণ শিকার। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সুন্দরবন থেকে শিকার করা ১টি বাঘের চামড়া, ১৯টি হরিণের চামড়া, ১৬ কেজি হরিণের মাংসসহ ৮ জন চোরা শিকারী ও বন্যপ্রাণির চামড়া পাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে সুন্দরবন বিভাগ, র‌্যার ও পুলিশ সদস্যরা।

বর্তমানে সার্বক্ষনিক সুন্দরবন পাহারায় আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট প্রেট্রোলিং চালিয়েও ঠেকানো যাচ্ছেনা বাঘ, হরিণ শিকারী, বন্যপ্রাণির চামড়া ও মাংস পাচার। নেপথ্যে গডফাদার থাকায় চোরা শিকারী ও বন্যপ্রাণির চামড়া পাচারকারী সিন্ডিকেটকে থামানো যাচ্ছেনা বলে অভিমত সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা পরিবেশবাদীদের।
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দবন বিভাগ ও র‌্যার- ৮ সদস্যরা গত ১৯ জানুয়ারী রাত ৮টার দিকে সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা সদরের রায়েন্দা বাস স্ট্যান্ড এলাকা থেকে ক্রেতা সেজে একটি পূর্ণ বয়স্ক বাঘের চামড়াসহ মো. গাউস ফকির (৪০) নামে পাচারকারীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার বাঘের চামড়া পাচারকারী বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের রশিদ ফকিরের ছেলে। বেশ কয়েক মাস আগে এই বাঘটিকে সুন্দরবন থেকে চোরা শিকারীরা হত্যা করে লবণ দিয়ে পলিথিনের বস্তায় ভরে রাখে। উদ্ধার হওয়া ৮ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা ও ৩ ফুট ১ ইঞ্চি চওড়া পূর্ণ বয়স্ক বাঘের চামড়াটি সে শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের অহিদুল নামে এক চোরা শিকারীর কাছ থেকে পাচারের জন্য কিনে রেখেছিল বলে জানায়। বন আইনে গ্রেফতার বাঘের চামড়া পাচারকারী গাউস ফকির বর্তমানে বাগেরহাট কারাগারে আটক থাকলেও এখনো আটক হয়নি বাঘ হত্যাকারী চোর শিকারী অহিদুল।

একইভাবে ২২ জানুয়ারী বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জ এলাকা থেকে শিকার করে আনা ১৯টি হরিণের চামড়াসহ দুই চোরা শিকারী ও পাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে জেলা ডিবি পুলিশ। ওইদিন দিবাগত রাত পোনে ২টার দিকে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার বাস ষ্ট্যান্ডের কাছ থেকে সুন্দরবনের চোরা শিকারী ও বন্যপ্রানী পাচারকারী চক্রের দুই সদস্য মো. ইলিয়াস হাওলাদার (৩৫) ও মো. মনিরুল ইসলাম শেখকে (৪৫) গ্রেফতার করে। এসময়ে তাদের গ্রেফতার করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করলে মনিরের বাসার দোতালা ঘরের কাঠের পাটাতনের উপর হতে দুটি ব্যাগে রাখা ১৯টি হরিণের চামড়া উদ্ধার করা হয়।

ডিবি পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, সুন্দরবন থেকে হরিণ শিকার করে এসব চামড়া পাচারের উদ্যেশে মজুদ করেছিল। গ্রেপ্তারকৃত সুন্দরবনের চোরা শিকারী ও বন্যপ্রানী পাচারকারী মো. ইলিয়াস হাওলাদার শরণখোলা উপজেলার রাজৈর গ্রামের মো. মতিন হাওলাদারের ছেলে ও মো. মনিরুল ইসলাম শেখ শরণখোলা উপজেলার বাস ষ্ট্যান্ডের এলাকায় বর্তমানে বসবাস করলেও সে বাগেরহাট সদরের ভদ্রপাড়া গ্রামের মো. মোশারেফ শেখের ছেলে। বন আইনে গ্রেপ্তার এদ্জুনও বাগেরহাট কারাগারে আটক রয়েছে।

গত ২৫ জানুযারী দিবাগত রাতে খুলনার দাকোপ উপজেলার পানখালী এলাকা থেকে সুন্দরবন থেকে শিকার করে আনা ১১ কেজি হরিণের মাংসসহ ২ শিকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরআগে রবিবার গভীর রাতে এই উপজেলার রামনগর গ্রামের ধোপাদী গেটের কাছ থেকে সাড়ে ৪ কেজি হরিণের মাংসসহ ৩ চোরা শিকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত এই ৫ চোরা শিকারীরা হলেন, খুলনার খানজাহান আলী থানার আটরা-পালপাড়া এলাকার খান খোলজার আহম্মদের ছেলে খান মুজিবুল সুলতান (৩৩), এই থানার মসিয়ালী এলাকার আয়নাল ফকিরের ছেলে মো. টিটু হোসেন (২৪), চট্টগ্রামের মিরসরাইরের বরাইয়া গ্রামের মুন্সি মোস্তফার ছেলে রুহুল আমনি (৫৬), রাঙ্গামাটির নানিয়াচরের ইসলামপুর গ্রামের আলী আকবর হাওলাদারের ছেলে আ. সোবহান (৬৫) ও খুলনার দাকোপ উপজেলার রামনগর গ্রামের জিতেন্দ্র নাথ রায়ের ছেলে কুমারেশ রায় (৫৫)। বন আইনে গ্রেপ্তার এপাঁচজনও খুলনা কারাগারে আটক রয়েছে।

এদিকে, বাংলাদেশ অংশের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনে গত ২০১৯ সালের ২২ মে সর্বশেষ বাঘ জরিপে বর্তমানে বাঘ রয়েছে মাত্র ১১৪ টি। আর হরিণ রয়েছে এক থেকে দেড় লাখ। ২০০১ সাল থেকে এপর্যন্ত বন বিভাগের হিসেবে ৫৪টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে মারা গেছে মাত্র ১৫টি। লোকালয়ে ঢুকে পড়া ১৪টি বাঘকে পিটিয়ে মেরেছে স্থানীয় জনতা, একটি নিহত হয়েছে ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন সিডরে ও বাকী ২৬ বাঘ হত্যা করেছে চোরা শিকারীরা। অধিক মুনাফার আশায় হরিনের মাংসসহ চামড়া, বাঘের অঙ্গ-প্রতঙ্গ, চামড়া, হাড়, দাত,নখ পাচার এখন নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। আর এটি দেশ ও দেশের বাইরে চীন-লাওস-থাইল্যান্ড সীমান্তে বন্যপ্রানী ও চামড়াসহ অঙ্গ-প্রতঙ্গের আন্ত:র্জাতিক চোরাই বাজার ‘গোল্ডেন ট্রাংগল’এ চলে যায় চোরকারবারী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।

২০১৮ সালের ১ নভেম্বর বনদস্যু মুক্ত ঘোষণার পর বাঘ ও হরিণ নিধন কমে এসেছে বলে বনবিভাগ দাবি করলেও মাত্র এক সপ্তাহে ১টি বাঘের চামড়া, ১৯টি হরিণের চামড়া, ১৬ কেজি হরিণের মাংসসহ ৮ জন চোরাশিকারী ও বন্যপ্রাণির চামড়া পাচারকারীকে গ্রেফতারে উঠে এসেছে সুন্দরবনের উদ্বেগজনক চিত্র।

সুন্দরবন নিয়ে গবেষনা করা প্রতিষ্ঠান ‘স্যাভ দা সুন্দরবন ভাইন্ডেশনের চেয়ারপাসন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, বন কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আধুনিক জলযান সংটক, দুর্বল বন আইনসহ সঠিক বন ব্যবস্থাপনার অভাব, মামলা পরিচালনায় অদক্ষতার অভাবে বাঘ, হরিণ শিকারী, বন্যপ্রাণির চামড়াসহ মাংস পাচারকারী সিন্ডিকেট ও রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী গডফাদারদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হবার কারণে সুন্দরবনে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বন্যপ্রানী হত্যা। সুন্দরবনে চোরা শিকারি পাশাপাশি বাঘের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হবার কারণেও হুমকির মুখে রয়েছে বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণি। এ অবস্থায় চলতে থাকলে হারিয়ে যেতে পারে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্যপ্রাণি।

বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, সুন্দরবনে বনদস্যুদের আত্মসর্ম্পপন করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা ও চোরা শিকারীদের দৌরাত্ব কম হওয়ায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘের সংখ্যা সর্বশেষ জরিপে বেড়েছে। ইতিমধ্যেই বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণির প্রজনন, বংশ বৃদ্ধিসহ অবাধ চলাচলের জন্য গোটা সুন্দরবনের আয়তনের ২৩ ভাগ থেকে ৫১ ভাগ বন এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এতে করে বাঘের প্রজনন, বংশ বৃদ্ধিসহ বন্যপ্রাণির অবাধ চলাচলের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণি হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে বর্তমানে সার্বক্ষণিক সুন্দরবন পাহারায় আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট প্রেট্রোলিং চালানো হচ্ছে। সুন্দরবনের চোরা শিকারী ও বন্যপ্রাণির চামড়া পাচারকারী সিন্ডিকেট বা তাদের পিছনে থাকা গডফাদারাও আমাদের নজরদারীর মধ্যে রয়েছে। কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছেনা। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে বন বিভাগ তৎপর রয়েছে বলে জানান এই বন কর্মকর্তা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত