আমদানীকৃত সাড়ে ৩ কোটি টাকার পণ্যের হদিস নেই: ঘটনা উদঘাটনে এগুচ্ছে কাস্টমস

মোংলা বন্দরে চলছে দুষ্ট চক্রের তৎপরতা

মো.মাসুদ রানা, মোংলা

আপডেট : ০৫:০১ পিএম, বুধবার, ৭ অক্টোবর ২০২০ | ৯৪০

মোংলা বন্দরে হঠাৎ করেই তৎপর হয়ে উঠেছে দুষ্ট চক্র। ঘোষনা অনুযায়ী পন্য আমদানী না করা, পণ্যবিহীন খালি কন্টেইনার আসা এবং আমদানী নিষিদ্ধ পণ্য আমদানী সহ শুল্ক ফাঁকির বিস্তার অভিযোগ উঠেছে। কাস্টমস শুল্ক বিভাগের গেল একমাসের নজরদারীতে উঠে এসেছে এ সব তথ্য। এ বন্দরে দু’দফায় আসা আমদানীকৃত সাড়ে ৩ কোটি টাকা সমমূল্য পণ্যের হদিস নেই । ঘোষনা পত্র ও কাগজ-কলমে থাকলেও মিল নেই বাস্তবে। বন্দরে আসা পণ্যের কায়ীক পরীক্ষায় ধরা পড়ে এসব গড়মিল।

সর্বশেষ গেল সপ্তাহে একটি আমদানীকারক প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে ৩১ টন পণ্য আসার ঘোষনা থাকলেও কায়ীক পরীক্ষায় পাওয়া গেছে মাত্র ৭টন। বন্দরে আসা এ পণ্যের চালানটি’র ২৪ টনই পাওয়া যায়নি। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় পৌনে এক কোটি টাকা। এর আগে অন্য এক প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে ৫৬ টন পণ্যের (কাপড়ের) মধ্যে প্রায় আড়াই কোটি টাকা মূল্যের ৪০ টন কাপড়ের খোঁজ মেলেনি। সিল ও লগ করা কন্টেইনার থেকে পন্য(কাপড়) গায়েব হওয়ার এ ঘটনা ঘটেছে। চীন থেকে আসা দু’দফায় দুটি প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ৩ কোটি টাকা সমমূল্যের পণ্যের কুলকিনারা করতে পারছে না কাস্টম। আর এ ক্ষেত্রে ৩ কোটি টাকার বেশি শুল্ক হারিয়েছে কাস্টম। এ ছাড়া পণ্য আমদানীর ঘোষনা থাকলেও খালি কন্টেইনার আসার ঘটনা ঘটেছে বন্দরে। একের পর এমন ঘটনা মোংলা বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে ভাবিয়ে তুলছে। তাই পণ্য চুরি ও দুষ্ট চক্রের তৎপরতা, মানি লন্ডারিং এবং শুল্ক ফাঁকিসহ ত্রি-মুখী প্রশ্ন মাথায় রেখেই নেপথ্যের ঘটনা উদঘাটনে সামনে এগুচ্ছে কাস্টমস।

মোংলা বন্দর ও কাস্টমস ব্যবসায়ী সহ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার কোতয়ালীর আহসানুল্লা সড়কের ১/১২৫ ঠিকানার মেসার্স নামিরা এন্টারপ্রাইজ এলসি’র মাধ্যমে চীন থেকে ৩১ টন (৩১ হাজার কেজি) থান কাপড়ের রোল আমদানী করে। ৪০ ফুট দৈর্ঘের একটি কন্টেইনার যোগে কাপড়ের এ চালানটি গত মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পৌছায় মোংলা বন্দরে। আর এ কাপড়ের চালানটি আসার পর কাস্টমস শুল্ক প্রদান প্রক্রিয়ায় ছাড় করাতে তেমন একটি তৎপরতা ছিল না আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান। যে কারনে টানা ৫ মাস ধরে কন্টেইনারে থাকা আমাদানিকৃত কাঁপড়ের চালানটি বন্দরের কন্টেইনার ইয়ার্ডে পড়ে থাকে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকা এ কাপড়ের চালানের শুল্ক প্রদান করে ছাড় করিয়ে নিতে আমদানিকারককে তাগিদ দেয় কাস্টমস।

এ প্রেক্ষিতে আমাদনীকারক প্রতিষ্ঠানের সম্মতিতে পণ্যের কায়ীক পরীক্ষার দিনক্ষন ও সংশ্লিষ্টদের সমন্বয় নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে কাস্টমস। গত ২৯ সেপ্টেম্বর বন্দরের ইয়ার্ডে থাকা কাপড়ের কন্টেইনারটি খোলা হয়। এ সময় আমাদনীকারকের ঘোষনা প্রত্র আনুয়ায়ী ওজন করা হলে ৩১ টনের পরিবর্তে মাত্র ৭ টন কাপড় পাওয়া যায়। বাকী ২৪ টন কাপড় কোথায় গেলো তা নিয়ে হরেকরকম প্রশ্ন ওঠে।

আমদানীকারক প্রতিষ্ঠানটির সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স আবুল হাসান এন্টার প্রাইজের স্বাত্বাধীকারী মোঃ মাসুদ রানা বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, মোংলা বন্দরের কন্টেইনার ইয়ার্ডের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে পণ্য(কাপড়) হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে আমাদানীকারকের মানিলন্ডারিং অথবা কন্টেইনার আসা জাহাজ ও পথিমধ্যে অনাকাংখিত ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয় সোমবার দুপুর ১২ টার দিকে সংশ্লিষ্ট সিএ্যান্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে সংগ্রহীত মেসার্স নামিরা এন্টার প্রাইজের প্রতিনিধি জনৈক পরশের সঙ্গে তার ব্যবহৃত(০১৯২১০৩৬৫১৪) মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি কাস্টমস ও সিএ্যান্ডএফর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে তার প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে ফোনালাপ করিয়ে দিতে ঘন্টা খানেক পরে আবার ফোন করতে বলেন। দ্বিতীয় দফায় বেলা ২ টার দিকে ওই নাম্বারে ফোন করলে মুঠো ফোনালাপে পরশ নামের ওই ব্যক্তি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং জানান প্রতিষ্ঠানের মালিক অসুস্থ্য থাকায় কথা বলা যাবে না।

এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর ৪০ ফুট দৈর্ঘের দুটি কন্টেইনারে ৫৬ টন কাপড় আমদানী করে মেসার্স জিম এ্যান্ড জেসি কমজিট লিমিটেড নামের অপর একটি প্রতিষ্ঠান। ওই দুটি কন্টেইনারে ৬শ’৬১ বেল্ট(রোল)কাপড় থাকার কথা থাকলেও কায়ীক পরীক্ষায় পাওয়া যায় মাত্র ২শ’১৬ বেল্ট কাপড়। বন্দরের আসার পর পরই কাস্টমের কায়ীক পরীক্ষায় ৪শ’৪৫ বেল্ট সমপরিমান ৪০ টন কাপড়ের সন্ধান মেলেনি। এ অবস্থায় কন্টেইনারবাহী জাহাজ বিভিন্ন দেশ ও বন্দর ঘুরে মোংলা বন্দরে পৌছায়। এ সকল বন্দর অতিক্রমকালে পথিমধ্যে নাকি মোংলা বন্দরে পৌছানোর পর ওই পণ্য (কাপড়) লোপাট কিংবা আমদানীকারক নামমাত্র এলসি’র মাধ্যমে বিদেশে অর্থ(মানিলন্ডারিং) করেছে কিনা ঘুরে ফিরে এ সকল প্রশ্ন উঠেছে। আর এ সব বিষয় নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান ও চালাচ্ছে কাস্টম কর্তৃপক্ষ। কন্টেইনার থেকে পণ্য উদাও হওয়ার ঘটনা ছাড়াও আমদানী পণ্যের ঘোষনার বিপরীতে খালী কন্টেইনার পৌছানোর ঘটনাও ঘটেছে মোংলা বন্দরে।

গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর মেসার্স সোবাহানাল্লা ট্রেড নামক একটি প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে পেম্পার, ডায়াপার ও পার্টি স্প্রে আমদানীর ঘোষনায় ৪০ ফুট দৈর্ঘের একটি পণ্যবাহি কন্টেইনার আসে। আমদানীকারক প্রতিষ্ঠানের সাড়া না পেয়ে এ কন্টেইনারটি’র কায়ীক পরীক্ষায় কোন প্রকার পন্য মেলনি। কাগজে কলমে এ প্রতিষ্ঠানের নামে রাজশাহীর একজিম ব্যংাকে এলসি দেখানো হয়। বাস্তবে আমদানীকারক এ প্রতিষ্ঠানের নামে ওই ব্যাংকে কোন অ্যাকাউন্ট এবং এলসি খোলার তথ্য-উপাত্ত খুঁজে পায়নি কাস্টমস। এ ঘটনায় শেষ পর্যন্ত কাস্টমস বাদী হয়ে শিপিং এজেন্ট সহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এ মামলাটি পিবিআই তদন্ত করছে বলে বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানিয়েছেন মোংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ ইকবাল বাহার চৌধুরী।

এ বিষয় মেসার্স সোবাহানাল্লা ট্রেড এর স্বাত্তাধীকারী এস এম মনিরুজ্জামান বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে তার প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার ও সুনাম নষ্ট করতে চক্রান্ত করছে। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন।


অপর দিকে গত ১৩ আগষ্ট টেনিসবল আমদানীর ঘোষনা দিয়ে আনা প্রায় ৩০ কোটি টাকা সমমূল্যের ৮০ মেট্রিকটন আমদানী নিষিদ্ধ পোস্তদানার চালান আটক করে কাস্টমসের শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগ। এ ঘটনার ৩দিন পর আমদানীকারক ঢাকার চকবাজারের মেসার্স তাজ ট্রেডার্স ও মেসার্স আয়শা ট্রেডার্স এবং মেসার্স ওসান ট্রেডার্স নামক শিপিং এজেন্টের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে কাষ্টমস। একই সঙ্গে আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান দুটির অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়। এ মামলাটি তদন্ত করছে মোংলা থানা পুলিশ। গত দু’মাসের ব্যবধানে দু’দফায় মোংলা বন্দরে আসা কন্টেইনারের পন্য গায়েব, পন্যবিহীন আসা খালি কন্টেইনার এবং আমদানী নিষিদ্ধ পন্য আমদানীর ঘটনা ঘটেছে।

মোংলা কাস্টম হাউজের ডেপুটি কমিশনার সুমন দাস বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, আমদানী পণ্যের ঘোষিত মুল্যের উপর ৯০ শতাংশ শুল্ক আদায় করে থাকে কাস্টমস। সেই হিসেবে দু’দফায় আমদানী কাপড়ের সিংহভাগের হাদিস না পাওয়ায় ৩ কোটি টাকার বেশি শুল্ক হারিয়েছে কাস্টমস।

ঘোষনা অনুযায়ী আমদানী পন্য না পাওয়ার ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাগেরহাট চেম্বারের সভাপতি লিয়াকত আলী বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, এ ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে নানা শংকা বিরাজ করছে। তবে ঘটনা খতিয়ে দেখতে লেডিং পয়েন্ট থেকে শুরু করে পণ্য খালাস হওয়া পর্যন্ত অনুসন্ধানী টিম গঠন করা জরুরী। একই সঙ্গে পণ্য হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা এবং সুরাহ না হলে মোংলা বন্দরের সুনাম নষ্ট হবে বলেও মনে করেন তিনি।

বন্দরে আসা কন্টেইনারের পন্য কম পাওয়া প্রসঙ্গে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাজান বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, মোংলা বন্দর জেটি সংরক্ষিত এলাকা। সিসি ক্যামরা ছাড়াও জেটি, ইয়ার্ড গেটে তৃতীয় স্তরের নিরাপত্তা বেষ্ঠনী রয়েছে। এ বন্দরে আসা কন্টেইনারজাত পণ্য খোয়া কিংবা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে মানিলন্ডারিং সহ ব্যবসায়ীক দুষ্ট চক্র মোংলা বন্দরের সুনাম নষ্ট করতে চাইছে বলে জানান তিনি।

নেপথ্যের ঘটনা উদঘাটনে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন বলে বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানালেন মোংলা কাস্টম হাউজের কমিশনার হোসেন আহম্মেদ। দাপ্তরিক কার্যক্রমে জনবল সংকটের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ঘোষিত পণ্যের সঠিক পরিমান না পাওয়া এবং বন্দরে খালি কন্টেইনার আসার ৩টি ঘটনাই আপাতত মানিলন্ডারিং হিসেবে দেখছেন তারা। তাই এ বিষয় ইতিমধ্যে মোংলা থানায় একটি মামলা দায়ের সহ আরও দুটি মামলার প্রস্তুতি চলছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত