জাতীয় সঙ্গীতের মূল কারিগর গগণ হরকরা
01/01/1970 12:00:00সিকদার মনজিলুর রহমান
সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের বিরাট রকমের একটা হৈচৈ উঠেছে । পরিবর্তন হবে কি হবে না সে বিতর্কে যাব না। ওটা রাজনৈতিক ব্যাপার। তবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের কথা উঠলেই খুব জোরেসোরে যার নাম সামনে চলে আসে ‘ তিনি গগণ হরকরা’। যার লিখিত এবং সুরারোপিত ‘ আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে ‘’ এই গানের সুর নিয়েই রবীন্দ্রনাথ তার ‘’ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ‘’ আমাদের জাতীয় সঙ্গীতটির গানের সুরারোপ করেন। কে সেই গগণ হরকরা? আসুন জানা যাক কে এই গগণ হরকরা?
লালন ভক্ত বাউল শিল্পী গগণ হরকরার পারিবারিক নাম গগণ চন্দ্র দাস বা দাম । আনুমানিক ১৮৪৫ সালে তৎকালীন পাবনা জেলার গোবরাখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই গুণীশিল্পী। গোবরাখালি গ্রামটি এখন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহের আড়পাড়া গ্রাম নামে পরিচিত। প্রথমে তিনি কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি কুষ্টিয়ার শিলাইদহের ডাকঘরে ডাক হরকরা বা ডাক পিয়নের চাকরি করতেন। ডাক হরকরা থেকেই গগণ দাস গগণ হরকরা নামে পরিচিতি লাভ করেন।
শিলাইদহ ডাকঘরে চিঠিপত্র বিলির কাজ করতেন তিনি। কিন্তু হৃদয়ে ছিল সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা। তার গানের গলাও ছিল বেশ । বিভিন্ন গানের আসরে তিনি করুণ রসের আবেশ লাগিয়ে এমন গান করতেন যা শ্রোতারা মুগ্ধ আবেশে ডুবতেন। লালনের এই ভাবশিষ্য প্রকৃতির রূপ, রস আর গ্রামের মেঠো মানুষের সারল্য, আবেগ ও ভালোবাসার বাউল দর্শনকে আশ্রয় করে গান রচনা করতেন। গগণ লালনের সান্নিধ্য খুব পছন্দ করতেন। তাই কাজে একটু অবসর পেলেই ছুটে তিনি যেতেন লালনের আখড়ায়। মজে যেতেন লালনের আধ্যাত্মিক সাধনায়।
গগণ দাস কার কাছ থেকে গানের দীক্ষা নিয়েছিলেন, তা জানা সম্ভব হয়নি, তবে তিনি লালনের গানের খুব ভক্ত ছিলেন। লালনও গগণের গান এবং গগণের সান্নিধ্য খুব পছন্দ করতেন। গগনের গানের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তিনি গগণের কাছে গগণের নিজের ও লালনের গান শুনতে পছন্দ করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পারিবারিক জমিদারি দেখাশোনা করতে কলকাতা থেকে ১৮৮৯ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত শিলাইদহ ও শাহজাদপুরে নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন। এই সময় তিনি বাউল গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। লালন, গোসাঁই গোপাল, ফিকিরচাঁদ, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী এবং গোসাঁই রামলালের মতো অসংখ্য বাউল শিল্পীর সাথে তার পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গগণ হরকরা।
কবি একদিন বজরার ছাদে বসে পদ্মার শোভা উপভোগ করছিলেন। এমন সময় ডাকঘরের এক পিয়ন চিঠির থলে পিঠে নিয়ে আপন মনে, ‘ আমি কোথায় পাব তারে / আমার আপন মানুষ যে রে’ এই গানটি গাইতে গাইতে সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে গান শুনে কবি মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি সেই ডাক হরকরাকে ডেকে পাঠালেন। স্থানীয় লোকজন তাকে গগণ হরকরা নামে চিনে, কিন্তু তিনি কবির কাছে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, তার নাম গগণ চন্দ্র দাস। গ্রামের সাধারণ এক মানুষ, নিজেই গান বাঁধেন এবং নিজেই সুর দিয়ে সে গান পরিবেশন করেন।
রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে যেতেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই ডাক পড়তো গগণের। সন্ধ্যার পর নির্জনে বোটের ছাদে বসে কিংবা শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে আয়োজিত কোনো গানের জলসায় গগণের গান ছিল উপভোগ্য। কবি ও তার বন্ধুবান্ধব গগণের গান শোনানোর জন্য উৎসুক থাকতেন।
শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে একবার গানের আসর বসে। বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। সাহিত্যিক ও গীতিকার হিসেবে তখন চারদিকে তার বেশ সুনাম। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বিশেষ বন্ধু। তার তদারকিতে ব্যস্ত বাড়ির সব মানুষ। খাওয়াদাওয়ার পর শুরু হলো গানবাজনা। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে গান গাইতে দু’বার অনুরোধ করতে হয় না। আসরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি গান পরিবেশন করেন। সকলেই সে গান শুনে বেশ তারিফ করলো।
এবার রবীন্দ্রনাথের পালা। কিন্তু সেদিন সকাল থেকেই তার গলায় অল্প ব্যথা। তিনি বন্ধুবরকে বললেন, আমার গান তো অনেক শুনেছো। আজ এক নতুন শিল্পীর গান শোন। আসরের এক কোনায় ফরাসের ওপর সঙ্কুচিত হয়ে বসে থাকা রোগা-হ্যাংলা এক ব্যক্তির দিকে তিনি নির্দেশ করতেই মানুষটি আরও কাঁচুমাচু হয়ে গেলেন, “রাজাবাবু, সত্যিই কী আমাকে ডেকেছেন?” এতসব বড় বড় গুণী মানুষেরদের মাঝে তাকে গান করতে হবে!
রবীন্দ্রনাথ গগণকে বন্ধুর কাছে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি শ্রোতাদের সকলকে অভিবাধন জানিয়ে শুরু করলেন,
‘লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী
পেলে মন হতো খুশি দেখতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিভাই অনল কেমন করে
মরি হায় হায় রে
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।‘
গগণের এই উদাত্ত কণ্ঠের গান শেষ হলে অনেকক্ষণ কারো মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরোলো না।
১৯০৫ সাল। ভাইসরয় লর্ড কার্জন বাংলাকে বিভক্ত করতে উদ্যত হলেন। ‘বঙ্গভঙ্গ’ অধ্যাদেশ জারি করলেন। চারিদিকে বাংলাকে বিভক্ত করার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। এই আদেশ আলোড়ন তুললো সারা বাংলায়, বিশেষ করে কলকাতার সুধীজনের মাঝে তার ব্যাপক প্রভাব পড়লো। প্রতিবাদের ঢেউ উঠলো সারা বাংলায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও এ প্রতিবাদে অংশ নেন। প্রতিবাদের জন্য চাই নতুন দেশাত্ববোধক গান। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥‘
দেশাত্ববোধক এ গানটিতে সুর দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গগণ হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানের সুরের আশ্রয় নিলেন। গগণের এই গানটির সুরকে রবীন্দ্রনাথ তার গানে প্রায় অবিকল তুলে আনেন। গানটি সুরারোপ করতে গগণ হরকরার অনুমতি নিয়ে ছিলেন কিনা তা জানা যায়নি ? বরং গগণ হরকরা খুশীই হয়েছিলেন যে, রাজাবাবু তার সুরারোপিত গান তার নিজের গানে ব্যবহার করছেন তাতেই তিনি নিজেকে ধন্য মনে করে ছিলেন । ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এই গানটিকেই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত মনোনিত করা হয় ।
পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গগনের আরও একটি গান ‘ও মন অসার মায়ায় ভুলে রবে, কতকাল এমনিভাবে’ এই গানটির সুরের আদলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেন,
‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়বো না মা!
আমি তোমার চরণ-
মা গো, আমি তোমার চরণ করবো শরণ, আর কারো ধার ধারব না মা।।
কে বলে তোর দরিদ্র ঘর, হৃদয় তোর রতন রাশি ‘
আমি জানি গো তার মূল্য জানি, পরের আদর কাড়ব না মা।‘
গগণ হরকরা আধ্যাত্মিক ভাবধারার প্রচুর গান রচনা করেছিলেন। তার সহজ-সরল শব্দময় এসব গানে মানবজীবনের রহস্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে। তার কয়েকটি গান সম্পর্কে জানা গেলেও তার অধিকাংশ রচনা সম্পর্কে তেমন একটা জানা যায় না। সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি তার রচিত অনেক গানের কথা ও সুর।
আমি কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষ যে রে’ এ গানটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে গগন হরকরার নাম। শুধু তাই নয়, ওই গান থেকেই সুর নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেন ‘ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ‘। সেই গানই এখন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। এই জাতীয় সঙ্গীতের সুরকার হলেন গগণ হরকরা।এই লোককবির স্মৃতি রক্ষার্থে একটা ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। যেটির অবস্থান কুষ্টিয়ার কুমারখালীর শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সংলগ্ন বেলগাছি মোড়ে।
গগণ হরকরার জন্মস্থান গোবরাখালি গ্রামে তার ভিটেমাটির কোন অস্তিত্ব এখন নাই। তবে লোকমুখে জানা যায়, ‘দুই যুগ আগেও গগণের ভিটা ও ফলের বাগানের অস্তিত্ব ছিল। শিলাইদহে গগণ হরকরার একটি বড় ফলের বাগান ছিল এবং গগনের বাস্তুভিটায় আসামদ্দি নামক একজন কৃষক বাড়ি করে থাকতেন। সেই বাড়িটি আজও ‘দাসের ভিটা’ নামে পরিচিত। তার পিতা-মাতা সম্বন্ধে তেমন কোনো তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে তার একটি ছেলের নাম কিরণ চন্দ্র দাস ছিল বলে জানা যায়।