চিতলমারীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা-২০২০ সম্মানপ্রাপ্ত পাঁচ নারী

এস এস সাগর

আপডেট : ০৬:৪০ পিএম, শুক্রবার, ১৮ জুন ২০২১ | ১৬৫৯

চিতলমারীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা-২০২০ সম্মানপ্রাপ্ত পাঁচ নারী

চিতলমারী উপজেলায় জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন পাঁচ জন নারী। তাদের শ্রেষ্ঠ জয়িতা-২০২০’র সম্মানে ভূষিত করেছে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। শ্রেষ্ঠ জয়িতা-২০২০ এর সম্মানপ্রাপ্ত পাঁচ নারী হলেন, অর্থনৈতিভাবে সাফল্য অর্জনকারী কনিকা মন্ডল, শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্যে নাজমা আক্তার, সফল জননী জয়ন্তী রানী ঘরামী, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরুকারী নারী শিখা রানী বৈরাগী এবং সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদানকারী নারী পূরবী রানী রায়। সংগ্রামী এই নারীদের জীবনের ঘটনা হৃদয়স্পর্শী ও অন্যদের জন্য শিক্ষণীয়। আর তাদের সংক্ষিপ্ত কিছু কাহিনী নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।


অর্থনৈতিকভাবে সফল কনিকা মন্ডল : চিতলমারীর চরবানিয়ারী ইউনিয়নের গোবিন্দ মন্ডল ও বিজলী মন্ডলের বড় মেয়ে কনিকা মন্ডল। ১৯৯০ সালে মা-বাবার পছন্দের পাত্রের সাথে তার বিয়ে হয়। স্বামী রসময় মন্ডল তখন বেকার। দারিদ্রতা ঘোচাতে ময়মনসিংহে একটি গার্মেন্টসে স্বামী, স্ত্রী চাকুরী শুরু করেন। বিয়ের তিন বছর পর কোল জুড়ে আসে মেয়ে, নাম প্রিয়াংকা মন্ডল। ১৯৯৮ সালে উন্মূক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। জন্ম হয় এক পুত্র সন্তানের, নাম পিয়াল মন্ডল। হঠাৎ সড়ক দূর্ঘটনায় স্বামীর একটি পা ভেঙে যায়। সংসারের সকল দায়িত্ব পড়ে কনিকার একার কাঁধে। কিছুদিন পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট থেকে একটি সেলাই মেশিন পান। শ্রমিকের চাকরির পাশাপাশি বাসায় সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন ধরনের কাপড় ও থ্রি-পিচ রাখেন। চাকরি আর ব্যবসা একসাথে চালাতে হিমসিম খায়। শ্রমিকের চাকরি ছেড়ে চিতলমারী চলে আসেন। বাড়িতে বসে দর্জি কাজ, সিট কাপড় ও থ্রিপিচের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায় উন্নতি হয়। দূর্গাপুর গ্রামে ১৩ শতাংশ জায়গা কিনে আধাপাঁকা বাড়ি করে বসবাস করছেন। কাপড়, দর্জি ব্যবসার পাশাপাশি হাঁস-মুরগির ব্যবসা করছেন। প্রতিমাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। কনিকা বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, সংসার এখন স্বচ্ছল। সুখে আছি।



শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সফল নাজমা আক্তার : নাজমার বয়স যখন প্রায় আড়াই বছর, তখন তার বাবার মৃত্যু হয়। দিন মজুর ভাই ও দরিদ্র মা অনেক কষ্টে তাকে লেখাপড়া শেখায়। এরপর মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে ও বাড়িতে বসে কাঁথা সেলাই করতেন। দু-বেলা পেট ভরে খেতে পারত না। মাধ্যমিক পর্যায়ে এসে তিনিও তার মায়ের সাথে কাঁথা সেলাই করতেন। ভাইয়ের সাথে চায়ের দোকানে ভাইকে সাহায্য করতেন। প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচ যোগাড় করেন। কোন আত্মীয় স্বজনেরা তাদের খোজ নেয়নি। এসএসসি পাস করার পর যখন কলেজে ভর্তি হতে চাইলেন, তখন পাশের বাড়ির লোকেরা নিন্দা করে। তারা নাজমার মাকে বলে, ঠিকমত খাওয়া জোঠে না, পড়ালেখা কী করে হবে। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেও। তার মা কারও কথা কানে তোলেনি। নাজমা কলেজে ভর্তি হন। বাড়ে পরিশ্রম। না খেয়ে লোকের বাড়িতে গিয়ে ছেলে মেয়ে পড়াতেন। বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত। যা জুটতো তাই খেয়ে নিজে পড়তে বসতেন। এভাবেই কাটে তার শিক্ষা জীবন।


এই প্রতিকূলতায় নাজমা চিতলমারী হাসিনা বেগম গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি, চিতলমারী বঙ্গবন্ধু মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং গোপালগঞ্জ সরকারী বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হতে বিএ অনার্স, ইসলামের ইতিহাসে মাষ্টার্স ১ম পর্ব শেষ করেন। এসময় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকুরী পান। মা মারা যান। নাজমার বিয়ে হয়। বড় ভাইকে দিন মজুরি ছাড়িয়ে পানের দোকান করে দেন। তিনি চিতলমারী ১০২নং কলিগাতী দক্ষিণপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। চিতলমারী সদর ইউনিয়নের কুরমনি গ্রামের কেয়াম উদ্দিন মাঝি ও মালেকা বেগমের মেয়ে নাজমা আক্তার।


সফল জননী জয়ন্তী রানী ঘরামী : চরবানিয়ারী ইউনিয়নের অশোকনগর গ্রামের নিরঞ্জন ঘরামীর স্ত্রী জয়ন্তী ঘরামী। তাদের দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলের আট বছর বয়সে দিনমজুর স্বামী মারা যান। মনকে শক্ত করে নিজেদের জমিতে নিজেরাই চাষাবাদ করেন। সন্তানেরা বড় হতে থাকে। খরচ বাড়ে। এক বিঘা জমি বিক্রি করে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগান দেন। এখন তাঁর বড় ছেলে গণিতে এমএ পাশ করে চরবানিয়ারী মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছোট ছেলে গণিতে এমএ পাশ করে আমরাগাছিয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মেয়ে নার্সিং এর পাশাপাশি বিএ পাশ করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নার্স পদে কর্মরত। জয়ন্তী বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে বলেন, সকল কষ্ট জয় করতে পেরেছি।


নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু করেন শিখা রানী বৈরাগী : শিখা রানী বৈরাগী ৫ম শ্রেণিতে পড়াকালে মা বাবা তাকে বিয়ে দেয়। বিয়ের প্রথম বছর ভালো ছিলেন। তারপর গায়ের রঙ কালো বলে তার স্বামী খারাপ কথা বলা শুরু করে। শিখা কিছুই বলতে পারেনা। কিছুদিন পর স্বামী রাত করে বাড়ি ফেরে। কারণ জিজ্ঞেস করলে শারীরিক নির্যাতন করে। শাশুড়ি শিখার খাবার নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে আরো এক বছর চলে যায়। শিখা মা হচ্ছে- একথা শুনে তার স্বামী খুব রাগ করে। স্বামী ও শাশুড়ি তার সন্তানকে মারার চেষ্টা করে। তিনি সাবধান হন। নবজাতকের ০৮ মাস বয়সে তার স্বামী কাজের কথা বলে গোপালগঞ্জ চলে যায়। মাস খানেক পরে বাড়ি এসে শিখাকে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তিনি সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যায়। ১৫ দিন পর শিখা স্বামীর বাড়িতে ফেরে। দেখে, তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে আর এক বৌকে ঘরে নিয়ে এসেছে। তাকে ঘরে উঠতে দেয়নি। বাড়ির বাইরে থেকে তাকে তাড়িয়ে দেয়। তিনি বাবার বাড়ি যান।

নির্যাতিত হয়ে স্বামীর ঘর থেকে বেড়িয়ে ভাসতে ভাসতে এক জনের বাড়িতে আশ্রয় পান তিনি। ঐ বাড়িতে তিনি ১০ বছর কাজ করেন এবং থাকেন। ব্র্যাক অফিস তাকে ০৮ (আট হাজার) টাকা দেয় ক্ষুদ্র ব্যবসা করার জন্য। তিনি যে বাড়িতে থাকেন তাদের অনুমতি নিয়ে চিতলমারী বাজার থেকে কাপড় কিনে গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করেন। আট বছর ব্যবসা করে তিনি ৩ শতক জমি কিনে বাড়ি করেন। তার মেয়ে এবার এসএসসি পরিক্ষা দেবে। তিনি আট বছর আগে থেকে ব্র্যাকের পল্লীসমাজের কমিটির সদস্য হিসাবে মানুষের সেবায় নিয়োজিত আছেন। তিনি এখন অন্যের বাড়িতে কাজ করেন না। নিজে ব্যবসা করেন। মেয়েকে নিয়ে তিনি ভাল আছেন। বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার হিজলা ইউনিয়নের শান্তিপুর গ্রামের সুব্রত বৈরাগীর স্ত্রী শিখা রানী বৈরাগী।


সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদানকারী নারী পূরবী রানী রায় : পূরবী রানী রায় পারিবারিকভাবে আর্থিক অসহযোগিতার জন্য সরকারী চাকরীর সুযোগ হারান। পরে এনজিও প্রদীপনে চাকরি শুরু করেন। ১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি চাকুরি করেন। এরপর গ্রামে ফিরে সমাজে পিছিয়ে থাকা নারীদের পাশে দাড়ান। তিনি দেখেন, খাসেরহাট বাজারে সরকারিভাবে নির্মিত মার্কেটে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরগুলো পুরুষের দখলে রয়েছে। এ ব্যাপারে গন্যমান্য ব্যক্তি ও প্রশাসনের সাথে আলোচনা করেন। অবশেষে মার্কেটের পাঁচটি ঘরে নারীরা অবস্থান পায়। এছাড়াও গ্রামের নারীদের শাক সবজি বাজারে বিক্রিতে উদ্ধুদ্ধ করেন। খাসেরহাটে খোলা চাতালে নারীদের দোকান বসার জন্য জায়গা বরাদ্দ করেন। এমন অসংখ্য নারী উন্নয়ন কাজ করছেন পূরবী রানী রায়। তিনি চিতলমারীর চরবানিয়ারী দক্ষিণপাড়ার প্রফুল্ল রায় ও মনোরমা রায়ের মেয়ে।

চিতলমারী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ হাফিজুর রহমান শুক্রবার (১৮ জুন) বাগেরহাট টুয়েন্টি ফোরকে জানান, সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের অগ্রগামী করতে প্রতি বছর সরকার এই সম্মাননা দেয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখায় ২০২০ সালের শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসেবে এই উপজেলায় এ পাঁচ নারীকে সম্মানিত করা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত