অস্তিত্ব সংকটে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য

খোন্দকার নিয়াজ ইকবাল

আপডেট : ০৮:৩০ পিএম, মঙ্গলবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১ | ২০৮০

বর্তমানে ভালো নেই ম্যানগ্রোভ সুন্দবনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবি চিত্রল হরিণ, জাতিসংঘের ঘোষিত রামসার এলাকার জলভাগের মৎস্য সম্পদ। শুধু বন্যপ্রানী ও মৎস্য সম্পদই নয়- নাশকতার আগুনেও পুড়ছে সুন্দরবন। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ‘স্মার্ট প্রেট্রোলিং’ আর জেলে-বনজীবীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে ঠেকানো যাচ্ছেনা বাঘ, হরিণ হত্যা। বন্ধ হচ্ছেনা খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার। আগুনদস্যুদের নাশকতার আগুনের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছেনা সুন্দরবনকে। এই অবস্থার মধ্যে অক্সিজেনের অফুরান্ত ভান্ডার দেশের ফুঁসফুঁসখ্যাত ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড সুন্দরবন এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। চোরা শিকারী, বন্যপ্রাণী পাচারকারী, বিষ ও আগুনদস্যুদের এই তান্ডপ থেকে রক্ষা পাচ্ছেনা সুন্দরবনের ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইডও। সুন্দরবন বিভাগের দেয়া তথ্যে এচিত্র ফুঁটে উঠেছে।

সুন্দরবনের প্রান-প্রকৃতি :
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনে আয়তন ছিল বর্তমানের দ্বিগুন। কমতে-কমতে বর্তমানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন এখন দাড়িয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। যা দেশের সংরক্ষিত বনভূমির সর্বমোট ৫১ ভাগ। ২৪ ঘন্টায় ২ বার সমুদ্রের জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয় সুন্দরবন। একই সাথে দিনবারত ২৪ ঘন্টা ৬ বার তার রূপ পাল্টানো সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৬৮ দশমিক ৮৫ ভাগ অর্থাৎ ৪ হাজার ২৪২ দশমিক ৬ বর্গ কিলোমিটার হচ্ছে স্থল ভাগ। সংরক্ষিত এই বনের ৩টি এলাকাকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড ঘোষনা করে। বর্তমানে যা সমগ্র সুন্দরবনের ৫২ ভাগ এলাকা। সুন্দরী, গেওয়া,গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি রয়েছে। এছাড়া ৩৭৫ প্রজাতির বন্য প্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, লোনা পানির কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিংকোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে।

সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইডের পাশাপাশি বিশে^র বৃহত জলাভূমিও। সুন্দরবনের জলভাগের পরিমান ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গ কিলোমিটার। যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। ১৯৯২ সালে সমগ্র সুন্দরবনের এই জলভাগকে রামসার এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। এছাড়া সুন্দরবনের সমুদ্র এলাকার পরিমান ১ হাজার ৬০৩ দশমিক ২ বর্গ কিলোমিটার। এই জল ভাগে ছোট বড় ৪৫০টি ছোট-বড় নদী ও খালে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা ও ১ প্রজাতির লবস্টার। ইতিধ্যেই সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেছে ১ প্রজাতির বন্য মহিষ, ২ প্রজাতির হরিণ, ২ প্রজাতির গন্ডার, ১ প্রজাতির মিঠা পানির কুমির।



খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার :
করোনাকালে গত ২৬ মার্চ থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত গোটা সুন্দরবনে সর্বোচ্চ সর্তকতা ‘রেড এ্যালার্ড’ জারি করে পর্যটক, জেলে-বনজীবীদের সুন্দবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে বন অধিদপ্তর। এই নিষিদ্দ সময়ের মধ্যেও হুমকিতে পড়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। বন বিভাগের দেয়া তথ্যই বলেদিচ্ছে ভেঙ্গে পড়ে সুন্দরবনের বন ব্যবস্থাপনা। প্রতি বছর সুন্দরবনের এই বিশাল জলভাগ থেকে আহরিত হয় ৪ হাজার ৪১৫ মেট্রিক টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এক শ্রেনীর জেলে বৈধ-অবৈধ পথে সুন্দরবনে ঢুকে অধিক লাভের আশায় ম্যানগ্রোভ এই বনের খালে বিষ দিয়ে মাছ আহরণ করে আসছে। এখন পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রানী হত্যার পাশাপাশি খালে বিষ দিয়ে মাছসহ জলজপ্রানী নিধনে চলছে মহোৎসব। গত ৬ মাসে সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে বিষ দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আহরণ কালে ১০জন ‘বিষ সন্ত্রাসী’কে গ্রেপ্তার করেছে বন বিভাগ। পালিয়ে গেছে ২৮জন বিষ সন্ত্রাসী। এসময়ে জব্দ করা হয়েছে ২৫ বোতল বিষ, বিভিন্ন প্রকারের ৭টি জাল, ২টি খালপাটা ও ১০টি নৌকাসহ বিষ দিয়ে আহরিত প্রায় ৭৭ কেজি বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়িসহ সাদা মাছ। বন বিভাগের দেয়া এতথ্য সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জের মধ্যে শুধুমাত্র চাঁদপাই রেঞ্জের। সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জের মধ্যে চাঁদপাই রেঞ্জে মাত্র ৬ মাসে বিষ দিয়ে মাছ আহরণের ভয়াবহ চিত্রই বলে দিচ্ছে ম্যানগ্রোভ এই বনের মাছসহ জলজ প্রানীকুলের বর্তমান অবস্থা। খালে বিষ দিয়ে মাছ আহরণের ফলে সুন্দরবনের মৎস্য ভান্ডার মাছশূন্য হয়ে পড়ার পাশাপশি খালে পানির বিষ বনের যেসব এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে সেসব বন এলাকার জীববৈচিত্র্যের উপরও মারাত্বক প্রভাব পড়ছে। ছোট-বড় সব প্রজাতির মাছ মারা য়াওয়ার পাশাপাশি মারা পড়ছে রপ্তানী পন্য বিশ^খ্যাত শিলা কাঁকড়াসহ অন্যসব জলজপ্রানী।

বাঘ, হরিণের চামড়া উদ্ধার :
গত ২০ জানুয়ারী বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে একটি বাঘের চামড়াসহ এক পাচারকারীকে আটক করে র‌্যাব-৮। এরপর গত ২২ জানুয়ারী আবারো বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে ১৯টি হরিণে চামড়াসহ দুই পাচারকারীকে আটক করে ডিবি পুলিশ। তারপর গত ২৫ জানুয়ারী খুলনার দাকোপ উপজেলার পানখালী খেয়াঘাট এলাকা থেকে ১১ কেজি হরিণে মাংসসহ দুইজনকে আটক করে পুলিশ। ৩১ জানুয়ারী বাগেরহাটের মোংলার দিগরাজ এলাকা থেকে ৪৭ কেজি হরিণের মাংস তিনজনকে আটক করে কোস্টগার্ড, ২ ফেব্রুয়ারী বাগেরহাটের রামপাল থেকে ৪৫ কেজি হরিণে মাংসসহ দুই পাচারকারীদের আটক করে ডিবি পুলিশ ও ১৭ ফেব্রুয়ারী রাতে বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার বৈদ্যমারী ফরেস্ট অফিস সংলগ্ন ইসহাকের চিলা এলাকায় থেকে সুন্দরবন হতে শিকার করা হরিণের চারটি পা, আধা বস্তা ফাঁদ, দুইটি ছুরি ও একটি নৌকাসহ দুই চোরা শিকারীকে আটক করেছে বন বিভাগ।



সুন্দরবনে ২৭ বার নাশকতার আগুন :
গত ৮ ফেব্রুয়ারী বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর টহল ফাঁড়ির কাছে ২৭ নম্বর কর্ম্পাটমেন্টের বনে নাশকতার আগুনে পুড়ে গেছে পাঁচ শতক জমির বলাগাছ ও লতাগুল্ম। সুন্দরবন বিভাগের তথ্যমতে, সুন্দরবনের বিলে মিঠাপানির মাছ আহরন করতে গত ১৫ বছরে আগুনদস্যুদের লাগানো ২৭ বারের নাশকতার আগুনে পুড়ে যায় প্রায় ৮০ একর বনভূমি। এরআগে ২০১৭ সালের ২৬ মে পূর্ব সুন্দরবনে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ফরেস্ট ক্যাম্পের আওতাধীন আবদুল্লাহর ছিলায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ওই আগুনে প্রায় পাঁচ একর বনভূমির গাছপালা,লতাগুল্ম পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ :
সুন্দরবন নিয়ে নিরান্তর গবেষনা করা প্রতিষ্ঠান সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাইন্ডেশনের চেয়ারপাসন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ হত্যার পাশাপাশি বন্ধ হচ্ছেনা খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার। আগুনদস্যুদের নাশকতার আগুনের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছেনা সুন্দরবনকে। করোনাকালে সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ সময়ে শুধু চাঁদপাই রেঞ্জেই নয়-অন্য ৩টি রেঞ্জেও অবাধে খালে বিষ দিয়ে মাছ অহরণ করা হচ্ছে। গত এক বছর ধরে দিনকে দিন সুন্দরবনে বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রানী হত্যার পাশাপাশি চলছে খালে বিষ দিয়ে মাছসহ জলজপ্রানী নিধনের মহোৎসব। দূর্বল বন ব্যবস্থাপনাসহ বন আইনে এসব অপরাধ জামিনযোগ্য হবার পাশাপাশি একশ্রেনীর অসাধু বন কর্মকর্তা অতি লোভের কারনে সুন্দরবন এখন অস্তিস্থ সংকটে পড়েছে। ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড এই ম্যানগ্রোভ বনসহ রামসার এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি বিশ্বের বৃহত জলাভূমির জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখন সময় এসেছে বন ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো। বাড়াতে হবে কর্মকর্তা-বনরক্ষীর সংখ্যা। বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রানী হত্যার পাশাপাশি মাছসহ জলজপ্রানী নিধনে বিষ সন্ত্রাসসহ পরিকল্পিত ভাবে বনে আগুল লাগানো দস্যুদের রুখকে জামিন অযোগ্য কঠোর বন আইন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপশি সুন্দরবনের পরিবেশ সংকটাপন্য এলাকা থেকে শিল্প-কলকারখানা সরিয়ে নেয়াসহ অসাধু বন কর্মকর্তা-বনরক্ষীদের কঠিন শাস্তির মুখোমুখি কারা গেলেই সুন্দরবন রক্ষা করা সম্ভব হবে।



সুন্দরবন বিভাগের বক্তব্য :
বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ৪টি রেঞ্জর ১৮টি রাজস্ব অফিস, টহল ফাঁড়িগুলোতেতে জনবলের সংখ্যা মাত্র ৮৮৯জন। এরমধ্যে পূর্ব বিভাগে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ শূন্য রয়েচে। এই অপ্রতুল জনবল দিয়ে বিশাল এই সুন্দরবনের প্রান-প্রকৃতিকে দেখভাল করা একটি দুরহ কাজ। সাম্প্রতিক সময়ে বাঘ, হরিণ হত্যার পাশাপাশি খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার ও আগুন দস্যুদের হাত থেকে সুন্দরবন রক্ষায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট প্রেট্রোলিংসহ সব ধরনের পাহারা জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি লোকালয়ে বাড়ানো হয়েছে নজরদারী। বন্যপ্রানী শিকার-পাচারকারীসহ বিষ ও আগুনদস্যুদের তালিকা করা হচ্ছে। অবাঞ্ছিত কোন লোকজনকে সুন্দরবনে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছেনা। একই সাথে সুন্দরবনের সব ধরনের সম্পদ আহরণে পাশ-পারমিট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সুন্দরবন রক্ষায় বন বিভাগ তৎপর রয়েছে বলেও দাবী করেন এই বন কর্মকর্তা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত