মোরেলগঞ্জে রবার্ট মোরেলের কুঠিবাড়ি অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন 

মেহেদী হাসান লিপন, মোরেলগঞ্জ

আপডেট : ০৬:৫১ পিএম, বুধবার, ১৯ অক্টোবর ২০২২ | ৬৮১

ইংরেজ শাসক রবার্ট মোরেলের নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। অযত্ন অবহেলা আর সংস্কারের অভাবে ১৪২ বছরের ইতিহান ঐতিহ্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।এখনো এ স্থাপনা সংরক্ষন করা না হলে ইংরেজ শাসনামলের কালের সাক্ষী অত্যাচারী মোরেলের শেষ স্মৃুতিচিহ্ন কালের অকলে হারিয়ে যাবে । প্রতিনিয়ত ভবনের মালামাল হচ্ছে চুরি। বেদখল হয়ে গেছে অনেক জমি।


১৮৪৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি মি. মোরেলের মৃত্যু হলে স্ত্রী মিসেস মোরেল তার দুই ছেলে রবার্ট মোরেল ও হেনরি মোরেলকে নিয়ে বসতি স্থাপন করেন পানগুছি নদীর পশ্চিমপাড়ে। সুন্দরবন বন্দোবস্ত নিয়ে শুরু করেন নীল চাষ। বাগেরহাট তখন মহকুমা হয়নি। খুলনা জেলাও ছিল যশোর জেলার অন্তর্গত। আর এর বড় অংশ জুড়ে ছিল সুন্দরবন। মিসেস মোরেল বরিশাল থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে বন আবাদ করে গড়ে তোলেন বিশাল আবাসস্থল ‘কুঠিবাড়ি’। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবকে দমন করে ইংরেজ শাসকরা এদেশে তাদের শাসন দৃঢ় করার লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তার মধ্যে এই কুঠিভিত্তিক শাসনব্যবস্থা ছিল অন্যতম।এরই অংশ হিসেবে এখানে গড়ে তোলা হয় সুরম্য অট্রাালিকা কুঠিবাড়ি ।

এ কুঠিবাড়ির তলদেশে নির্মিত হয় অশ্বশালা। গোপন সুড়ঙ্গসিঁড়ি দিয়ে সরাসরি নামা যেত অশ্বশালায়। এ ছাড়াও কুঠিবাড়ির অভ্যন্তরে আনন্দ কক্ষ বা নাচঘর, গুদামঘর, নির্যাতন কক্ষ ও লাঠিয়াল বাহিনীর জন্য পৃথক কক্ষ ছিল। মূল এই ভবনটির পাশে ছিল কাচারিঘর, অবাধ্য শ্রমিকদের বেঁধে রাখার ঘর ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত মালামাল রাখার ঘর। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্য প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পেতে কুঠিবাড়ির চতুর্দিকে উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। ওই সময় মূল শাসকের দায়িত্ব পালন করেন রবার্ট মোরেল। তার নাম লেখা হতো ‘দ্বিতীয় এডমন্টন রয়েল মিডেলসেক্স মিলিশিয়া রাইফল পল্টনের কাপ্তান রবার্ট মোরেল’।

১৮৬৮ সালের ১৩ মে বরিশালেই রবার্ট মোরেল মৃত্যুবরণ করেন। এরপরে আর বেশিদিন টেকেনি মোরেল পরিবারের শাসন। মোরেলগঞ্জ থেকে ১৮৭৮ সালে শাসন গুটাতে হয় তাদের। তবে কালের সাক্ষী হয়ে এখনো রয়ে গেছে ‘কুঠিবাড়ি’ নামে পরিচিত মোরেলদের নীলকুঠি’র ধ্বংসাবশেষ। মোরেল পরিবারের বিদায়ের শেষ দিকে মোরেলের ভক্ত ও অনুসারীরা কুঠিবাড়ির অদূরে নির্মাণ করেন মোরেলের স্মৃতিস্তম্ভ। স্তম্ভটি এখনো আছে। এতে বাংলা ভাষায় শ্বেত পাথরে লেখা রয়েছে, ‘দ্বিতীয় এডমন্টন রয়ল মিডেলসেক্স মিলিশিয়া রাইফল পল্টনের কাপ্তান রবার্ট মোরেল সাহেব ৪২ বছর বয়স প্রাপ্ত হইয়া ১৮৬৮ সালের মে মাসের ১৩ তারিখে বরিশালে মৃত হওয়াতে তদীয় মহালের আমলা তালুকদার হাওয়ালদার ও রায়তেরা তাহার স্মরণার্থ এই স্তম্ভ নির্মাণ করিলেন’। ফলকটির নিচে লেখা রয়েছে ‘লিওলিন এবং কোং, কলিকাতা’।

মোরেলগঞ্জ পৌরসভায় অবস্থিত মোরেলদের এই ‘কুঠিবাড়ি’ ভবনের পুরনো আমলের সেই দরজা, জানালা, গ্রিল, সিন্দুক, সিঁড়িসহ বহু মূল্যবান মালামাল ধীরে ধীরে বেহাত হয়ে গেছে। স্মৃতিস্তম্ভ থেকেও চুরি হয়ে গেছে অনেক মালামাল। প্রায় দেড়শ বছর ধরেই পুরনো ও ঐতিহাসিক এই ভবনটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। দীর্ঘ এই সময়ে ভবন বা এর মালামাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেউই কোনো দায়িত্ব নেয়নি, উদ্যোগও গ্রহণ করেনি।

এ সর্ম্পকে ঐতিহ্যবাহী কুঠিবাড়িকে নিয়ে গবেষক প্রাক্তন অধ্যক্ষ ম্যাটস্ বাগেরহাট ডা. মো. শিব্বির আহ্মেদ বলেন, কুঠিবাড়ি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এটি আজ ধংসের দ্বারপ্রান্তে। ইতোপূর্বে অনেক জমি অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণ করে দেখভালের জন্য দায়িত্ব গ্রহনের দাবি জানান তিনি। পাশাপাশি কুঠিবাড়ির এ জমিতে শিশু বিনোদনের জন্য শিশু পার্ক তৈরির উদ্যোগ গ্রহন করা হলে একদিকে শিশুদের বিনোদনের চাহিদা লাঘব হবে। আয়ের উৎস্য থেকে সরকারিভাবে রাজস্ব আসবে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কুঠিবাড়িকে সংরক্ষনের জন্য ইতোমধ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে সুপারিশ প্রেরণ করা হয়েছে। ইতিহাস ঐতিয্য ধরে রাখতে সরকারিভাবে বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত